সত্যিই কী মমতা-অভিষেকের মতপার্থক্যের চোরাস্রোত বইছে তৃণমূলের অন্দরে?

সত্যিই কী মমতা-অভিষেকের মতপার্থক্যের চোরাস্রোত বইছে তৃণমূলের অন্দরে?

differences

কলকাতা: নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে একটি সমাবেশ। এমন বহু সভা-সমাবেশ মমতার উপস্থিতিতে রাজ্যে হয়েছে৷ আগামী দিনেও হবে।‌ কিন্তু গত বৃহস্পতিবারের ওই সমাবেশ রাজ্য রাজনীতিতে পাকাপাকিভাবে বিশেষ কারণে ‘মাইলস্টোন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে না তো? কারণ এই সমাবেশের পরেই তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ যেভাবে একাধিক ইস্যু তুলে ধরে কার্যত দলের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাতেই নানা জল্পনা তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, মমতা ও অভিষেকের মধ্যে মতপার্থক্যের জেরে বিতর্কের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। এই বিষয়টি নিয়ে আগেও বহু জল্পনা হয়েছে। তবে কুণাল ঘোষ খুল্লামখুল্লা ভাবে বিশেষ একটি সংবাদমাধ্যমের সামনে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে বিষয়টি নিয়ে চর্চা এখন তুঙ্গে।

তাই প্রশ্ন, অভিষেক কী এতটাই শক্তিমান নেতা হয়ে গিয়েছেন যেখানে তিনি মনে করলে, একাই তৃণমূলকে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন? অভিষেক পুরোপুরি মমতার আলোয় আলোকিত, এমনই বলে থাকেন সমালোচকরা। মমতা চেয়েছেন বলেই আজ অভিষেক  দলের ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’৷ কিন্তু এখনই যদি মমতা নতুন করে কাউকে সেই উচ্চতায় তুলে ধরতে চান সেটা অনায়াসে সম্ভব হবে। টিম মমতায় যোগ্য নেতার অভাব তো নেই৷

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে অসম্ভব ভাল ফল করে, যাতে ব্যাকফুটে চলে যায় তৃণমূল। এরপর এমন প্রেক্ষাপট রাতারাতি তৈরি হয় যেখানে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতে ক্ষমতায় আসবে, এমন চর্চা শুরু হয়ে যায় রাজ্য তথা দেশজুড়ে। সেখান থেকে মমতা একার কাঁধে লড়াইয়ের দায়িত্ব তুলে দেন।   পায়ে চোট পাওয়ার পর হুইলচেয়ারে বসে রাজ্য জুড়ে প্রচার করেন। তবে মমতা শুধু একা নন, অভিষেকও রাজ্য জুড়ে দেড়শোর বেশি সভা করেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে  ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন অভিষেক৷ ‘পরামর্শদাতা’ হিসেবে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করে তৃণমূল৷ প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাকের কর্মীরাও নাওয়া-খাওয়া ভুলে মাঠে-ময়দানে নেমে কাজ শুরু করেন৷ মূলত, হুইলচেয়ারে বসে রাজ্যজুড়ে মমতার একের পর এক সভা, অভিষেক ও প্রশান্ত কিশোরের কৌশলের উপর ভর করে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফের ক্ষমতায় আসে তৃণমূল।

বিজেপির প্রত্যাশার বেলুন নিমেষে ফুটো হয়ে যায়। তাই সেই জয়ের কৃতিত্ব অভিষেককেও দিয়ে থাকেন তৃণমূলের নবীন প্রজন্মের নেতাকর্মীরা। তবে বাস্তবটা হল, মমতা যেভাবে বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে নেমেছিলেন, সেটা যদি সম্ভব না হত, তাহলে তৃণমূল হালে কতটা পানি যেত, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বিশ্লেষকদের একাংশ৷

বাম আমলে তিন দশকের বেশি সময় ধরে মমতার আপসহীন লড়াই দেখেছে গোটা রাজ্য। শূন্য থেকে কীভাবে লড়াই করা যায়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ খোদ মমতা৷ অথচ, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অভিষেক রাজনীতিতে এসেই বড় আসন পেয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ কোনও দিন মাঠে নেমে লড়াই না করেই আজ অভিষেক তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’। হালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টানা দু’মাসের যে জনসংযোগ কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তারও প্রধান ব্যবস্থাপনায় ছিল ‘আইপ্যাক’ই৷ গোটাটাই সুচিন্তিত কর্মসূচি৷ লড়াই কিংবা আন্দোলন কি বলা যায় নবজোয়ারকে? আর যদি সত্যিই অভিষেকের নিজস্ব ম্যাজিক থাকবে, তাহলে মূলত তাঁর নেতৃত্বে গোয়া, ত্রিপুরার নির্বাচনে লড়ে তৃণমূল প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত কি আদৌও হত? এই প্রশ্ন তো উঠবেই।

দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই দুটি রাজ্যে নির্বাচনী রণকৌশল অভিষেক ঠিক করেছিলেন বলে জানা যায়। বারবার তিনি ছুটে গিয়েছেন এই দুটি রাজ্যে। কিন্তু সেখানে চরম ব্যর্থ হয়েছে তৃণমূল। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন মমতা তাঁকে বড় সুযোগ দিয়েছেন বলেই অভিষেক আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছেন। এর বাইরে অন্য কিছু নেই সেখানে। তা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই তৃণমূলের নবীন প্রজন্মের নেতাকর্মীদের একাংশ অভিষেককে সামনে রেখে নতুন ভাবে কিছু করে দেখাতে চাইছেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা গিয়েছিল সেই জয়ের কৃতিত্ব অভিষেককে দিয়ে তাঁর ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো হয়েছিল। যদিও একদিনের মধ্যেই সেগুলি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। অর্থাৎ শুধু বর্তমান সময়কাল বলে নয়, সাত বছর আগেই তৃণমূলের একাংশ সেই চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে সেটা সফল হয়নি। এই আবহের মধ্যে কুণাল ঘোষ যে বক্তব্য রেখেছেন তার যে যথেষ্ট রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven − 9 =