মৌমিতা বিশ্বাস: বিশ্বজুড়ে যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে, তাতে শিহরিত গোটা মানবজাতি৷ করোনা আতঙ্ক ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে মানুষের মনে৷ এই আতঙ্ক এতটাই বেড়ে গিয়েছে, যে মানুষের কাছে মানুষ আজ অস্পৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ রূপটা ভিন্ন হলেও, যেন ফিরে এসেছে মধ্যযুগীয় শুচিগ্রস্ততা৷ শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়েই অযথা হেনস্থা করা হচ্ছে মানুষকে৷ করোনা নিয়ে প্রশাসনের তরফে বারবার বলা হচ্ছে, গুজব ছড়াবেন না বা গুজবে কান দেবেন না৷ কিন্তু যে কোনও ঘটনায় রং না চড়িয়ে খান্ত হচ্ছে না মানুষ৷ এমনই এক ঘটনার সাক্ষী চুঁচুড়ার বড়বাজারের বাসিন্দা চম্পা সিংহ৷
ঘটনার সূত্রপাত শেওড়াফুলি থেকে চনন্দনগর ইউনাইটেড নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া করোনা আক্রান্ত রোগীকে কেন্দ্র করে৷ গত ২২ মার্চ ইউনাটেড নার্সিংহোম জ্বর নিয়ে ভর্তি হন ওই রোগী৷ ২৯ মার্চ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা চলে তাঁর৷ পরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয় তাঁকে৷ সোয়াব পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি করোনা পজিটিভ। চন্দননগরে তিনি ড.শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ যিনি আবার যুক্ত রয়েছেন চুঁচুঁড়ার অজন্তা সেবা সদন হাসপাতালের সঙ্গেও৷ শেওড়াফুলির ওই রোগী করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরই সিল করে দেওয়া হয় ইউনাইটেড নার্সিংহোম৷ চন্দনগরের বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যান ওই চিকিৎসক৷ তবে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত তাঁর দুটি পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ৷ আগামীকাল আরও একটি রিপোর্ট আসার কথা রয়েছে৷ সেই রিপোর্টের অপেক্ষাতেই এখন গোটা শহরের মানুষ৷
এদিকে, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে গত পরশু থেকে রোগী ভর্তি বন্ধ রাখেন অজন্তা সেবা সদনের মালিক সঞ্জয় সিংহ৷ শান্তনুবাবুর রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তিনি নার্সিংহোমে নতুন করে রোগী ভর্তি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন৷ কিন্তু খবর রটে, ওই নার্সিংহোমে রয়েছে করোনা আক্রান্ত রোগী৷ শুধু তাই নয় পুলিশ ও সিএমওএইচ নিজে এসে নার্সিংহোম সিল করে দিয়েছেন৷ এরপর থেকেই চূড়ান্ত হেনস্থার মুখে পড়তে হয় সঞ্জয়বাবুর স্ত্রী চম্পা সিংহকে৷ পাড়া প্রতিবেশিরা এসে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকেন তাঁকে৷ তাঁদের বাড়ির পাশেরই এক ভদ্রলোক এসে চম্পাদেবীকে খবর দেন, অজন্তা সেবাসদন সিল করে দেওয়া হয়েছে৷ এমনকী সঞ্জয়বাবুকে আইসোলেশনে পাঠানোর পরামর্শও দেন তিনি৷ আইসোলেশনে পাঠানো না হলে, তা আইনি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে বলেও অভিমত তাঁর৷ চম্পাদেবী ও তাঁর দশ বছরের ছেলেকেও পরীক্ষা করানোর জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করেন ওই ভদ্রলোক৷ অথচ ওই তিনি নিজে লকডাউনের নিয়ম ভেঙে অযথা ঘুরে বেরাচ্ছেন পাড়ায় পাড়ায়৷ পুলিশের নজর এড়িয়েই ওই পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডার ঠেকে দেখা যাচ্ছে তাঁকে৷
চম্পাদেবী বলেন, এখানেই শেষ নয়৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে তাঁর নম্বরে৷ কারোর প্রশ্ন, আপনাদের নার্সিংহোমে কতদিন ছিল ওই করোনা রোগী? কেউ আবার বাড়ি বয়ে এসে তাঁকে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন৷ সকাল থেকেই শুরু হয়েছে উড়ো ফোনের উৎপাত৷ চম্পাদেবী বলেন, এদিন সকালে গেটে জল দেওয়ার সময় আশেপাশের বাড়ির লোকজন এমন বক্রদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন যে, তাতে মনে হচ্ছিল তিনি সত্যি সত্যিই করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন৷ পাড়ার লোকের কাছে তিনি এখন অস্পৃশ্য৷ বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময়ও তাঁদের শোনানো বাঁকা কথা৷
আরও এক প্রতিবেশির মতামত, আপনাদের নার্সিংহোমে যখন শান্তনু মুখোপাধ্যায় এসেছেন, তখন করোনাভাইরাসও এসেছে শহরে৷ আপনারা সকলে অবিলম্বে অন্যত্র যাবার ব্যবস্থা করুন৷ পাড়া প্রতিবেশির এহেন মন্তব্যে মানসিক চাপে পড়েছেন চম্পাদেবী৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের বাড়িতেই রয়েছেন চম্পাদেবী ও তাঁর ছেলে৷ কিন্তু অলক্ষ্যেই তিনি হয়েছেন একঘরে৷ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সঞ্জয়বাবু জানান, ‘‘পরিবার ছেড়ে দিনরাত নার্সিং হোমে পড়ে রয়েছি মানুষের সেবা করতে৷ আমরা সরকারের নির্দেশিকা মেনে মানুষের পাশে রয়েছি৷ কিন্তু একদল অসৎ মানুষ নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছেন শহরে৷ চন্দননগরের ঘটনাটি জানার পরই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে আমরা নার্সিংহোমে রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু ড. শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের দুটি রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পর ফের পরিষেবা চালু করা হয়েছে৷ সরকারের সহযোগিতাতেই কাজ করে চলেছি আমরা৷’’
শুধু চম্পাদেবীই নন৷ হেনস্থার শিকার তাঁদেরই এক অ্যাম্বুলেন্স চালকের পরিবার৷ গুজব রটেছে ওই চালক নাকি অ্যাম্বুলেন্সে করে করোনা আক্রান্ত রোগীকে বেলেঘাটা আইডিতে নিয়ে গিয়েছেন৷ পাড়ায় টিকে থাকা দায় হয়ে উঠেছে তাঁর পরিবারের৷ এদিন অসহায় হয়েই চম্পাদেবীর কাছে ছুটে আসেন ওই চালকের মা৷ অথচ গত তিনদিন ধরে নার্সিংহোম থেকে বাড়িই ফেরেননি ওই চালক৷করোনা মোকাবিলায় সরকার যে নির্দেশিকা জারি করেছে, তাতে কোথাও উল্লেখ নেই, অযথা সন্দেহ বশবর্তী হয়ে মানুষকে হেনস্থা করার কথা৷ গুজব ছড়ালে কঠিন সাজা দেওয়া হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তা সত্ত্বেও যেন শুরু হয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা৷ বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়েই মাথাচারা দিচ্ছে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার৷ সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করছে সামাজিক ছুঁতমার্গ৷