তপন মল্লিক চৌধুরী : বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজো পুরোদমে শুরু হতে চলছে৷ তার কয়েক দিন আগে থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুজো উদ্বোধন শুরু করে দিয়েছেন। তিনি যেমন সব জায়গায় সপারিষদ হাজির হন, তেমনভাবেই মণ্ডপে যাচ্ছেন। মণ্ডপগুলির কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, ফলে পরিসর কম। অল্প জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বিধি জলাঞ্জলি দিয়ে ঠাসাঠাসি ভিড়।তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী দুর্গা মূর্তির চোখ আঁকা শুরু করেন। সেই ছবি দেখা যায় চ্যানেলে, সংবাদপত্রে। নবান্ন সূত্রে এও জানা যায়, আগামী কয়েকদিন মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যেক সান্ধ্যায় ব্যস্ত থাকবেন পুজো উদ্বোধনে। তার মধ্যে কিছু ভার্চুয়াল, বাদবাকি সশরীরে।
কেবলমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নন, তার দলেরছোট-বড় মাঝারি নেতা মন্ত্রীরাও আছেন প্রতিমা উদ্বোধন কর্মযঙ্গে। অন্যবারের তুলনায় এবার বিষয়টি অনেক বেশি গভীর। কারণ, সামনে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। করোনা অতিমারীতে সংক্রমণের সতর্কতা মুখে বললেও পুজো উদ্বোধনে তা কার্যত ফাঁকা আওয়াজ। তাই মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের উদ্যোগটা বেশিই চোখে পড়ছিল।
করোনা পরিস্থিতি তখন বেশ আশঙ্কাজনক। হাসপাতালগুলি পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। শিয়রে বাঙালির দুর্গোৎসব কিন্তু তা নিয়ে তখনও দোলাচল অবস্থা। পুজো কমিটিগুলিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে বেশিরভাগই কোনোক্রমে উৎসব পার করতে চাইছে। এমনসময় সরকারের উদ্যোগে পুজো কমিটিগুলোকে নিয়ে সভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সব দ্বিধা ঘুচিয়ে দিয়ে তিনি উন্মুক্ত করে দিলেন উৎসবের দরজা।
একের পর এক ঘোষণায় নগদ অনুদান ছাড়াও বিদ্যুৎ বিলে ভরতুকির কথাও জানালেন। মুখ্যমন্ত্রী এও জানান, পৌরসভা-পঞ্চায়েত সাধ্যমত সাহায্য করবে পুজো কমিটিগুলিকে। যারা কি করবেন ভাবছিলেন, না চাইতেই তাদের ঝুলি বেমালুম ভরে গেল। এরপর কি আর করোনা পুজো ঠেকাতে পারে।
করোনা বিপর্যয়ে রাজ্যের কী হাল তা সবারই জানা। ভাইরাসসংক্রমণ, মৃত্যু যেমন আছে, অন্যদিকে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি, অসংখ্য মানুষের কর্মচ্যুতি, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপন্নতা… এখনেই শেষ নয়। স্কুল বন্ধ, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কিংবা স্কুলে মিড-ডে মিল নেই। আমফানের পর আজও বহু মানুষ নিরাশ্রয়।বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ লক্ষ টাকা, তাও বেড মিলছে না। সরকারি হাসপাতালে যে কী চলছে তা না বলাই ভাল।এমন আরও খণ্ডচিত্র জুড়লে যে অসহায় পরিস্থিতিটাতৈরি হয় বাস্তব তার চেয়েও নির্মম। কিন্তু পুজো কমিটিগুলির জন্য কয়েকশো কোটি টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সামনে নির্বাচন তাই চিকিৎসকদের আবেদনে সাড়া দেওয়া যায় না।পুজো কমিটিকে সরকারি অনুদান দেওয়াটা কতখানি নৈতিক তাও ভেবে দেখা যায় না। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তাকে তাচ্ছিল্য করে, কোভিড-সতর্কতার বিধি তুচ্ছ করে তাই সর্বজনীন পুজোকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার তোড়জোর। থাক স্কুল-কলেজ বন্ধ। ট্রেন কবে কিভাবে চলতে পারে, সে ভাবনা আপাতত তোলা থাক।ইতিমধ্যে রাজ্যে সংক্রমণ উর্ধ্মুখী।বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে গোষ্টী সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কাও করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
চিকিৎসকরা পুজোয় স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।তারপর ভিড় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলার রায়ে হাই কোর্ট স্পষ্ট জানাল, করোনা আবহে এই বছরের দুর্গাপুজোয় মণ্ডপ দর্শকশূন্য রাখতে হবে। কনটেনমেন্ট জোন হিসাবে গণ্য করা হবে প্রতিটি পুজো মণ্ডপ। ছোট প্যান্ডেলের ৫ মিটার আর বড় মণ্ডপের ক্ষেত্রে ১০ মিটার দূরত্বে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। এছাড়াও পুজোর এরিয়া ব্যারিকেড করতে হবে।এই রায়ে সরকার এবং পুজো কমিটি যে খুশী নয় তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু পুজোর বাজার করতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তারপর থেকেই করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। রাজ্যে একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার হাজার। কিছুদিন আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন চিকিৎসকরা। সেখানে তাঁরা উল্লেখ করেছিলেন, মানুষের ভিড় যদি পুজোতে ঠেকানো না যায় তাহলে রাজ্যে করোনা সুনামি দেখা যাবে। কেরলের ওনাম উৎসব তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কোনও হেলদোল ছিল না। তিনি তৃতীয়া থেকে ঠাকুর দেখতে বললেন।পাশের রাজ্য উড়িষ্যা, আসামকে দেখেও তাঁর বোধদয় হল না। বুঝতে অসুবিধা হয় তাঁর এই বেপরোয়া উচ্ছ্বাস কোথা থেকে কিভাবে আসে? তিনি একদিকে বলবেন সাবধানে থাকুন অন্যদিকে বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে দেদার উৎসবেমত্ত হওয়ার সব বন্দোবস্ত করবেন, এর মানেটা কি?