বিশ্বদীপ নন্দী, বালুরঘাট: দুর্গোৎসবের বিসর্জনের বাজনা বাজতেই, উত্তরবঙ্গে শুরু হয়ে যায় বোল্লাকালীপুজোর। প্রতিবছর এই পুজো ও মেলাকে ঘিরে ১০ লক্ষ মানুষের সমাগম হলেও, এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। করোনাবিধি মেনে কোনওরকমে মায়ের পুজো সমপন্ন করা হচ্ছে। একাধিক বিধি নিষেধ জারি করা হয়েছে। তবে ভক্তি, ঐতিহ্যে ভাটা পড়েনি দক্ষিণ দিনাজপুরের শতাব্দী প্রাচীণ বোল্লা কালীপুজোয়।
কয়েকশো বছর আগে এলাকার জমিদার ছিলেন বল্লভ মুখোপাধ্যায়। শোনা যায়, তাঁর নাম অনুসারেই এলাকার নাম হয় বোল্লাগ্রাম। কথিত আছে, আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে, এলাকার এক মহিলা স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি কালো পাথর কুড়িয়ে পান, সেটিতেই তিনি শুরু করে মায়ের পুজো। এমনকী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন নথিতেও এই ঐতিহ্যশালী পুজোর উল্লেখ রয়েছে। আবার অনেকের মতে, এলাকায় চারশো বছর আগের জমিদার ছিলেন মুরারিমোহন চৌধুরী। তিনিই নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছে পাথরের মূর্তি উদ্ধার করে পুজো শুরু করেন, শুরু হয় নিত্যপুজো। সেই সময় প্রতি বছর জৈষ্ঠমাসের অমাবস্যার রাতে মা বোল্লাকালীর বিশেষ পুজো হত। কথিত আছে, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং গ্রেপ্তার হন ইংরেজদের হাতে তিনি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় জমিদার বল্লভ মুখোপাধ্যায়, আরেক জমিদার মুরারি মোহন চৌধুরীর পূজিত রক্ষাকালী মতান্তরে মারাক্কা কালী মাতা এবং অধুনা বোল্লা রক্ষা কালীর কাছে মানত করেন। ওই মামলায় তিনি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই জয়লাভ করলে সেই বছর থেকে রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার থেকে তিন দিন ঘটা করে এই পুজো শুরু করেন। আজও প্রত্যেক বছর রাশ পুর্নিমার পরের শুক্রবার বোল্লা মায়ের পুজো হয়ে আসছে।
পুজোর রীতিতে এখন বদল এসেছে। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর পর, প্রথম শুক্রবার মা বোল্লাকালীর কাঠামো পুজো করা হয়। সকালে ঢাক, কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে স্থানীয় পুকুর থেকে মায়ের পুরানো কাঠামো তুলে আনা হয়। তারপর দুধ দিয়ে সেই কাঠামোকে পুজো করা হয় লাল কাপড়ে মুড়ে। এরমধ্য দিয়েই বোল্লাকালীপুজোর বাৎসরিক পুজোর সূচনা করা হয়। রাসপূর্ণিমার পর প্রথম শুক্রবার বাৎসরিক পুজো সম্পন্ন করা হয়। তবে এবার করোনা এবং স্বাস্থ্যবিধি মাথায় রেখে পুজো করতে হচ্ছে অনাড়াম্বরে। এলাকার বাসিন্দা ছাড়া কাউকেই মন্দিরপ্রাঙ্গনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। থাকছে না ভোগ বিতরণ ও বিশেষ পুজো দেওয়ার ব্যবস্থাও। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে পুজো মণ্ডপ। এলাকায় টহলদারী চালাচ্ছে পুলিশ। পাশাপাশি মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে পুলিশের ক্যাম্প। পুজো কমিটির সভাপতি দীপক কর্মকার বলেন, ‘‘প্রথমে আমরা প্রতিবারের মতোই পুজো ও উৎসব করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রশআসন বৈঠক করে জানিয়ে দেয় এবার প্রতিবারের মতো পুজো করা যাবে না। যেহেতু বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস চলছে, সেই জন্য আমাদের অনেক সতর্ক হয়ে থাকতে হবে। সেই জন্য অনেক নিয়মকানুন রাখতে হয়েছে।” সকাল থেকে অন্যবারের ব্যস্ততাও চোখে পড়েনি।আর সেই জন্য মন খারাপ ভক্তদেরও। তেমনই এক ভক্ত সঞ্জয় সাহা বলেন, “মনে থেকে এরকম ভাল লাগছে না। এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। আমি আসতে পেরেছি তার জন্য আমি গর্বিত। কিন্তু অনেক লোকই এখানে আসতে পারছে না।’’
এই মেলা যে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম মেলা সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোচবিহারের রাস, জল্পেশ এবং জহরামেলার সঙ্গেই বোল্লা মেলার নাম উচ্চারিত হয়। প্রতি বছর দশ থেকে বারো লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। করোনার মতো মহামারী দূর হোক, বোল্লাকালীর কাছে এমনটাই প্রার্থনা এলাকাবাসীর।