কিষেণজির পথেই কি গুরুংয়ের পরিণতি? নাকি গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে মান্যতা?

কিষেণজির পথেই কি গুরুংয়ের পরিণতি? নাকি গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে মান্যতা?

তপন মল্লিক চৌধুরী : করোনাকালে দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার দেদার ছাড়ের পর হাইকোর্টের রায়ে উৎসবে লাগাম পড়ায় যথেষ্ট অস্বস্তি বেড়েছে শাসক দলের৷ সেই অবস্থায় পলাতক গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুং ধর্মতলার হোটেলে বসে সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলের হাত ধরার কথা ঘোষণা করেন৷ কেবল তাই নয়, তার পরই গুরুংদের স্বাগত জানিয়ে তৃণমূল পরপর দুটি ট্যুইট করায় প্রশ্নের মুখে এখন শাসকদল৷

ফেরার মোর্চা নেতা বিমল গুরুংকেবেশ কিছু কাল ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল রাজ্য পুলিশ। সেই গুরুং নাটকীয়ভাবে কোথা থেকে কীভাবে এতদিন পর আবির্ভূত হলেন সল্টলেকের গোর্খা ভবনের বাইরে? কেন তাঁকে কোন পুলিশ গ্রেফতারের চেষ্টা করল না? গোর্খা ভবনের দরজা খোলা না পেয়ে কীভাবে তিনি সেখান থেকে গাড়িতে করে চলে এলেন কলকাতার হোটেলে এবং সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জানিয়ে দিলেন, ২০২১ এর ভোটে তিনিও তাঁর দল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূলকে সমর্থন করবেন।

যে লোকটি গত তিন বছর ধরে ফেরার, একাধিক মামলায় অভিযুক্ত থাকার কারণে রাজ্য পুলিশ যাকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত হন্যে হয়ে খুঁজেছে, জানা গিয়েছিল তিনি নাকি ঝাড়খন্ডে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন, হঠাৎ তিনি একদিন কলকাতায় এসে সারাদিন ঘুরে বেড়ালেন, সাংবাদিক সম্মেলন করলেন, অথচ তাঁকে ধরতে পুলিশের তরফে কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না, বরং তিনি তৃণমূলের সমর্থনে পাহাড়ে নির্বাচনে লড়বেন এই কথা জানানোর পর শাসক দলের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হল।

স্বভাবতই প্রশ্ন, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে গুরুংয়ের মদতে বিজেপির টিকিটে দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তার কি তাহলে এবার তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন?  গুরুং তো জানিয়ে দিয়েছেন, ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে লড়বেন। গুরুং একথাও জানিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যে মোর্চা ও তৃণমূল একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করতে চলেছে। তবে তিনি এ কথাও জানাতে ভোলেন না, মোর্চা গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে এক পাও সরে যায়নি। তাহলে শাসক দল তৃণমূল যে গুরুংকে স্বাগত জানাল তা কি পৃথক গোর্খাল্যান্ড বা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার দাবি মেনেই?

দীর্ঘ বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশানায় ছিল জঙ্গলমহল ও পাহাড়। পাহাড় ও জঙ্গলে শান্তি ফেরাতে এবং উন্নয়নের বন্যা বওয়াতে তিনি যে সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কারও কোনও দ্বিমত নেই৷ তাঁর মুখে সেসময়কার সব চেয়ে জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল পাহাড় হাসছে-জঙ্গলমহল হাসছে। কিন্তু পরবর্তীতে এই জঙ্গলমহল ও পাহাড় তাঁকে আর খুশী রাখতে পারেনি। জঙ্গলমহলের মানুষ যেমন শাসক দলের থেকে মুখ ফিরিয়েছে পাহাড়েও বিভিন্ন সময় গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সোচ্চার গোর্খা জনমুক্তি রাজ্য সরকারের সঙ্গে মোর্চার বিরোধ লেগেই থাকত।

পাহাড়ের রাশ নিজের হাতে ধরে রাখতে রাজনৈতিক কুশলী মমতা নানাভাবে পাহাড়ের মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ করেছেন। শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন জেলা গড়েছেন। একদা মোর্চার সহ সভপতি বিনয় তামাং নিজেকে দলের সভাপতি ঘোষণা করলে তাঁকেই জিটিএ-র সর্বোচ্চ পদে বসান মুখ্যমন্ত্রী। গুরুংকে শায়েস্তা করতে তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দায়ের করেছে। ঘটনা পরম্পরায় পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ যেমন বদলেছে, অন্যদিকে মোর্চার অন্দরেফাটল ধরেছে। একসময় কার্যত পাহাড়ের রাশ ধরে ফেলেন মমতা। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে পাহাড়-সহ গোটা উত্তরবঙ্গের সমতলে তৃণমূলের সংসারে সুখ নেই।

রাজ্যের বিধানসভার ভোট এগিয়ে আসতেই হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল। ইতিমধ্যে নেত্রী জেলা সফর শুরু করেছেন। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়া একদা জন সাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাত তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় রাজ্য রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি হয়েছিল। আর ৩ বছর অজ্ঞাতবাসের পর ফেরার বিমল গুরুং কলকাতায় এসে খোলাখুলি তৃণমূলকে সমর্থনের জানানোয় রাজ্য রাজনীতিতে ব্যাপক বদলের সম্ভবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের ১৫টি আসন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে খুবই গু্রত্বপূর্ণ। এর মধ্যে পাহাড়ের দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পং, সমতলের ফাঁসিদেওয়া এবং কালচিনিও বিধানসভায় গোর্খাদের আধিপত্য রয়েছে। এমনকি শিলিগুড়ি, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেও কিছুগোর্খা ভোট রয়েছে। গত লোকসভায় সবগুলি আসনেই বিজেপি এগিয়েছিল। তৃণমূলকে বিজেপির কাছ থেকে আসনগুলি ছিনিয়ে আনতে তৃণমূল কি তবে গুরুংয়ের সঙ্গে হাত মেলাবে? গুরুংয়ের সাহায্য নেওয়ার অর্থ পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি মেনে নেওয়া? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি সে পথে হাঁটবেন নাকি গুরুংকে কিষেণজি বানাবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − 14 =

BIG BREAKING: খাস কলকাতায় বিমল গুরুং, যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল বাংলার পুলিশ!

BIG BREAKING: খাস কলকাতায় বিমল গুরুং, যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল বাংলার পুলিশ!

 

কলকাতা: খাস কলকাতায় অবাধে ঘুরলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সুপ্রিমো বিমল গুরুং৷ ৩ বছর পর এই প্রথম প্রকাশ্যে এলেন তিনি৷ তাও গোপনে নয়, বরং খাস কলকাতায়৷ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গত ২০১৭ সাল থেকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল বিমল গুরংকে৷ পাহাড় থেকে জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে গুরুংয়ের টিকি ছুঁতে পারেনি পুলিশ৷ গুরংয়ের সন্ধান পেতে ভিন্ রাজ্যে ছুটেও লাভ হয়নি৷ দীর্ঘ ‘চোর-পুলিশে’র পর পঞ্চমীর সন্ধায় আচমকা কলকাতায় গুরংয়ের উপস্থিতি ঘিরে নতুন করে তৈরি হয়েছে বিতর্ক৷ ঝাড়খণ্ডের গাড়ি নিয়ে আজ সটান সল্টলেকের হাজির হন দীর্ঘ দিন ধরে ফেরার থাকা বিমল গুরুং৷

দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর খোঁজ চালাচ্ছিল রাজ্য পুলিশ৷ দেড় বছর ধরে তাঁর কোনও খোঁজ মেলেনি৷ অবশেষে সকলকে হতবাক করেই প্রকাশ্যে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুং৷ পঞ্চমীর বিকেলে তিনি পৌঁছন সল্টলেকের গোর্খা ভবনে৷ এদিন প্রায় ৪০ মিনিট গোর্খা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভিতরে ঢোকার অনুমতি পাননি বিমন গুরুং৷ ফলে গাড়ির ভিতরেই অপেক্ষা করছেন তিনি৷ গোর্খা ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে রাখেন নিরাপত্তা কর্মীরা৷

বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি আছে, সেই অভিযোগগুলির ভিত্তিতেই তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল৷ এদিন সল্টলেকে গোর্খা ভবনে ঢুকতে চাইলেও তাঁকে বাধা দেওয়া হয়৷ প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করার পর গাড়ি নিয়ে চলে যান গুরং৷ ৪০ মিনিট ধরে বিমল গুরুং অপেক্ষা করলেও পুলিশের তরফে এখনও কোনও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ এদিন সকাল থেকেই রাজনৈতিক মহলে বিমল গুরুংকে নিয়ে চলছিল জল্পনা৷ তিনি রাজভবনে যেতে পারেন বলেও চলছিল কানাঘুষো৷ পরে তিনি সল্টলেকের গোর্খা ভবনে পৌঁছে যান৷ সেখানে প্রবেশ করতে না পেরে ফের রওয়ানা হন গুরুং৷ পরে সেখান থেকে গ্রেট ইস্টান হোটেলে আশ্রয় নেন তিনি৷

এদিন সকাল থেকেই রাজনৈতিক মহলে বিমল গুরুংকে নিয়ে চলছিল জল্পনা৷ তিনি নবান্নে যেতে পারেন বলেও চলছিল কানাঘুষো৷ পরে যানা যায় তিনি সল্টলেকের গোর্খা ভবনে যাচ্ছেন৷ গোর্খা ভবনে ঢুকতে চাইলে জানানো হয়, তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার কোনও অনুমতি নেই৷ তৃণমূল সরকারের সঙ্গে গুরুংয়ের সঙ্ঘাত কারও অজানা নয়৷ এই সঙ্ঘাত এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে দার্জিলিং ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার এই নেতা৷ এতদিন গা ঢাকা দিয়েই ছিলেন তিনি৷ তবে মাঝেমধ্যে গোপন আস্তানা থেকেই পাঠাতেন ভিডিও মেসেজ৷ এই সময় বিজেপি’র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথাও উঠে আসে৷ তবে সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া চলছে বলেও খবর রটে৷ দেড় বছর পর আচমকা গুরুংয়ের প্রকাশ্যে আসা সেই জল্পনাকেই উস্কে দিচ্ছে৷ তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি গুরুং৷ তিনি বলেন, যা বলার গোর্খা ভবনে ঢুকেই বলবেন৷ রাজ্য পুলিশ থেকে সিআইডি, দীর্ঘ দিন ধরে খোঁজ চালাচ্ছিল বিমল গুরুংয়ের৷ কিন্তু তাঁরা কোনও কিনারা পায়নি৷ অবশেষে আজ আচমকা সল্টলেকে উপস্থিত হন তিনি৷ এখানে সাংবাদিক বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর৷  তবে বিমল গুরুংকে গ্রেফতারও করা হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে৷

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গুরুংয়ের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১২০টির বেশি মামলায় রয়েছে৷ কোনটায় কী ধারা, কী অভিযোগ? তা আগেই জানতে চেয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট৷ গুরংকে নিয়ে সেই মামলাগুলি এখনও চলছে৷ ২০১৭ সালে জুনে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড়ে আগুন জ্বালানোর পর থেকে পুলিশের খাতায় ফেরার ছিলেন গুরং৷ তারপর থেকে বিমল গুরুং ছিলেন বেপাত্তা৷ পরে চলতি বছর মার্চ মাসে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার ছেলের বিয়ের ভোজসভায় দেখা গিয়েছিল গুরুংকে৷ নবদম্পতির সঙ্গে বিমল-রোশনের ছবি ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক৷ এবার খাস কলকাতায় রাজ্যে প্রথম দেখা দিলেন গুরুং৷ কিন্তু, ২০১৭ সালের জুনে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি পাহাড়ে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে টানা ১০৫ দিন ধরে পাহাড় অচল করে দেওয়া, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপরে হামলার মতো ঘটনার পর দায়ের হওয়া খুন, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর-সহ একাধিক ধারায় মামলার পরও কীভাবে খাস শহর কলকাতায় ঘুরে বেরালেন গুরুং? যাঁকে নাকি দীর্ঘ দিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছিল বাংলার পুলিশ! পুজোর মধ্যে গুরুয়ের আর্বিভূত হওয়া নতুন করে বাড়িয়েছে বিতর্ক৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × one =