কলকাতা: সম্প্রতি চীনে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। নতুন এই মারণ ভাইরাসকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে গোটা বিশ্বে।
করোনাভাইরাস গুলি এমন ধরণের ভাইরাস যা সাধারণত মানুষ সহ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শ্বাসযন্ত্রের অংশগুলির ওপর মারাত্মক প্রভাবশালী। পাখিদের সংক্রামক ব্রংকাইটিস ভাইরাস থেকে এই ভাইরাসটি পৃথকভাবে প্রথমবার চিহ্নিত করা হয় ১৯৩৭ সালে।
গত ৭০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে করোনভাইরাসগুলি ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, টার্কি, ঘোড়া, শূকর, অন্যান্য গবাদি পশু এবং কিছু বিশেষ পাখিদের সংক্রামিত করতে পারে।
অর্থাৎ পশুপাখিদের শরীরেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে এই ভাইরাসের কয়েকটিমাত্র প্রজাতি মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এমনকি পশু পাখিদের শরীর থেকে মানুষের শরীরে এর সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনাও কদাচিৎ।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) অনুসারে বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই কোনো এক সময়ে করোনভাইরাস সংক্রামন হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসগুলি নিম্ন-শ্বসনতন্ত্রের অসুস্থতা যেমন নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কাইটিস আকারেও দেখা দিতে পারে। করোনাভাইরাসগুলি ভাইরাসের একটি বড় পরিবার যা সাধারণ সর্দিকাশি থেকে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতার কারণ হতে পারে। তবে পশুপাখি থেকে মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে মারাত্মক বলে মনে করা হয় মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (এমইআরএস-সিওভি) এবং সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (এসএআরএস) কে। তবে এবার এই সংক্রমণ আরও মারাত্মক আকারে দেখা দিয়েছে এবং একে বলা হচ্ছে '২০১৯ এনসিওভি'।
করোনাভাইরাসের উৎস ও দ্বিমত –
চিনের স্থানীয় একটি সামুদ্রিক খাবার ও প্রাণিজ খাবারের বাজারে গেছিলেন এমন মানুষদের শরীর এই প্রথম এই সংক্রমণ ঘটায় আধিকারিকরা মনে করছেন এই বাজার থেকেই রোগটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। তবে নতুন ২০১৯ এন সিওভি-র জিনগত ক্রম করোনা পরিবারের অন্তত ২০০ টি প্রজাতির সঙ্গে তুলনা করে পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ চীনের দুটি পরিচিত প্রজাতির সাপের শরীর থেকে এই সংক্রমণ তৈরি হয়েছে। নানান ধরণের ক্রেইট (বাংগারাস মাল্টিসিনেক্টাস) এবং চীনা কোবরা (নাজা আতরা)। যদিও সাপের দেহে এই করোনা ভাইরাস আদৌ সংক্রমণ ঘটাতে পারে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বেশ কিছু গবেষক।
কীভাবে করোনাভাইরাস পশুদের শরীর থেকে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে?
কিছু ভাইরাস মানুষের শরীরের স্থানান্তরিত হতে বিশেষভাবে সক্ষম। করোনাভাইরাস সেই ভাইরাস গুলির মধ্যে একটি। কিন্তু কিভাবে? জার্নাল অব মেডিকেল ভাইরোলজি তে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সাপের শরীর থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে সক্ষম হয় তাহলে তা কিভাবে? এক্ষেত্রে নতুন '২০১৯ এন সিওভি'-র মধ্যে ভাইরাল প্রোটিন গুলির যে পরিবর্তন হয় তার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন অন্য হোস্ট সেল শনাক্ত করতে এবং রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে সক্ষম। গবেষকরা বলছেন এই বিশেষ প্রোটিনের পরিবর্তনের ফলেই মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের ('২০১৯ এন সিওভি) সংক্রমণ ঘটছে।
এক ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে কিভাবে?
খুব সীমিত হলেও প্রাথমিকভাবে পশুপাখিদের শরীর থেকেই মানুষের শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমণ ঘটছে। তবে গবেষকরা বলছেন একবার কোনো মানুষের শরীরে এই করোনাভাইরাস প্রবেশ করলে তা সহজেই অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম।
কীভাবে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে জানিয়েছেন গবেষকরা।
*আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি থেকে ভাইরাস বহনকারী কনা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়।
*আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা তার সঙ্গে হাত মেলালে সেখান থেকেও সংক্রমণ ছড়ায়।
*পারিপার্শ্বিক কোন জিনিস বা মেঝেতেও এই ভাইরাস থাকতে পারে। সেখান থেকেও সংক্রমণ ছড়ায়।
*মলমূত্র থেকে এই সংক্রমণ খুব কম ক্ষেত্রে ছড়ায়।
এই ভাইরাস বা মানুষের মধ্যে মহামারীর আকার নিতে পারে এরকম যে কোনো ক্ষেত্রে তিনটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো: প্রথমে ভাইরাসটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটি মানুষকে সংক্রমিত করে, এরপর তার শরীরে প্রতিলিপি তৈরি করে এবং অন্য মানুষের মধ্যে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হলেও স্বস্তির খবর একটাই যে, সিডিসি বলছে, এই ভাইরাসটি এখনও মানুষের মধ্যে সীমিত সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। যদিও পুরো বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন আধিকারিকরা।