অভিনয়ে মন দিলে অনেক দূর যেতে পারতেন অর্পিতা, মত তাঁর পরিচালকদের

অভিনয়ে মন দিলে অনেক দূর যেতে পারতেন অর্পিতা, মত তাঁর পরিচালকদের

কলকাতা:  রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার অন্যতম চক্রী তিনি৷ তাঁর ঘরে হানা দিয়েই উদ্ধার হয়েছে ‘টাকার খনি’৷ কিন্তু মন্ত্রী ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতার জীবন শুরু হয়েছিল বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়ার আটপৌরে একটা বাগানঘেরা বাড়ি থেকে। সেখানেই মা মিনতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী কালে সেই বাড়ি ছেড়ে বেলঘড়িয়াতেই দুটি ফ্ল্যাট কেনেন৷ এর পর আরও বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট বদলে থিতু হন দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ায়৷ তাঁর ঠিকানা হয় ডায়মন্ড সিটি আবাসন৷ 

আরও পড়ুন- ব্রেকিং: ভর্তি করার দরকার নেই! পার্থকে ছেড়ে দিচ্ছে এইমস

দেওয়ানপাড়া থেকে ডায়মন্ড সিটি আবাসনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে পৌঁছনোর এই যাত্রা কেমন ছিল?  কী ভাবে একেবারে সাদামাটা পরিবার থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে মডেলিং-অভিনয়ের জগত ঘুরে আচমকাই চলে এলেন আর্থিক বিতর্কের কেন্দ্রে? কী ভাবে উত্থান অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের! কী ভাবেই বা নোটের পাহাড় জমল তাঁর ফ্ল্যাটে? উত্তর খুঁজতে নেমে উঠে আসছে একের পর এক চমকে দেওয়ার মতো তথ্য৷ 

অর্পিতার বাবা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী৷ মোটামুটি সচ্ছ্বল পরিবার৷ মা মিনতিদেবী গৃহবধূ। অর্পিতারা দুই বোন। দিদি বিবাহিত৷ কলকাতাতেই পড়াশোনা অর্পিতার। কলেজে পড়াকালীন শুরু করেন মডেলিং। অর্পিতার কলেজের ‘বন্ধু’ সৌমেন রায় সংবাদমাধ্যমে জানান, বরাবরই চনমনে ছিলেন অর্পিতা। কোনও কিছুতেই ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না তিনি৷ এমনকী কলেজ জীবনের অর্পিতাকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিব ‘গো-গেটার’৷ অর্থাৎ কোনও কিছু ভেবে নিলে সেটা আদায় করে ছাড়া।  

জানা গিয়েছে, অর্পিতার কলেজের পড়াশোনা শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই প্রয়াত হন তাঁর বাবা। সেই সময় মডেলিংয়ের পাশাপাশি অভিনয়েরও চেষ্টা করছেন অর্পিতা। বাবা চাকরিরত অবস্থায় মারা যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিটি তাঁর কন্যাকে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। তবে অর্পিতা তা গ্রহণ করেননি। অর্পিতার মায়ের কথায়, ‘‘তখন ও চুটিয়ে মডেলিং, অভিনয় করছে। ওড়িয়া আর তামিল ছবিতেও অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে৷ তাই চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল।’’

২০০৪ সাল নাগাদ মডেলিং শুরু অর্পিতার। ২০১০ সালে প্রথম অভিনয়৷ পাকাপাকি ভাবে অভিনয় জগতে আসার আগেই ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাঁর। কিছু দিন তাঁরা এক সঙ্গে ছিলেন বলেও কানাঘুষো। যদিও সেই সম্পর্ক বেশি দিনের নয়। মডেলিংয়ের পাশাপাশি রূপসজ্জার প্রশিক্ষণও নেনে তিনি। ‘নেল আর্ট’টাও শিখে নেন৷ কয়েক বছরের মধ্যে পাটুলি, লেক ভিউ রোড এবং বরানগরে তিনটি নেল আর্ট স্টুডিও খুলে ফেলেন অর্পিতা। কোথা থেকে একসঙ্গে তিনটি স্টুডিও খোলার টাকা পেলেন? এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি অর্পিতা।

‘স্পর্শ’ নামের একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়৷ তবে অনুপ সেনগুপ্তের ‘মামা-ভাগ্নে’ ছবির পর তিনি পরিচিতি পান৷ ২০১০ সালে মুক্ত পাওয়া ওই ছবিতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিৎ মল্লিক, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন৷ 

সেই অনুপ তাঁর ছবির অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে সাড়ে ২২ কোটি টাকা উদ্ধারের খবরে হতবাক। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘ অর্পিতা আমার ‘মামা-ভাগ্নে’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘বাংলা বাঁচাও’ ছবিতে পরপর কাজ করেছিলেন। তার পরে আর যোগাযোগ রাখেননি। ১২ বছর পর এইভাবে শিরোনামে উঠে এল! বড্ড অবাক লাগছে।’’ তার দাবি, ‘‘লোভ মানুষকে কোথায় নামিয়ে আনে।’’

অর্পিতার কথায় চমকে উঠেছন বিজেপির কলকাতা জেলা সভাপতি তথা চলচ্চিত্র পরিচালক সংঘমিত্রা চৌধুরীও। সংঘমিত্রা বলেছেন, ‘‘আমার দু’টি সিনেমায় অভিনয় করেছিল ও। এক পরিচিত যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে বলেছিল, অর্পিতা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। ২০১১ সালে ও আমার ছবির শ্যুটিংয়ে আসত বাসে, ট্রেনে চড়ে৷’’ সংঘমিত্রার জানান, ২০১৩ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অর্পিতার৷ 
সঙ্ঘমিত্রার কথায়, ‘‘শুধু অভিনয়টাই করলে ও অনেক দূর এগিয়ে যেতেই পারত। রূপের পাশাপাশি অভিনয় দক্ষতাও ছিল ওঁর মধ্যে। কিন্তু চার চেয়েও বেশি ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ও শুরু থেকেই বেশি উপার্জনের জন্য অন্য ভাষায় ছবি করার কথা বলত।’’ সে কারণেই অর্পিতা চলে গিয়েছিল ওড়িয়া ও তামিল ছবিতে৷ 

এর পর ২০১২ সালই রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাল বন্ধু’ বলে অর্পিতার নাম প্রকাশ্যে আসে৷ ২০১৯ সালে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে উঠে আসে অর্পিতার মুখ। ঘটনাচক্রে, সেই পুজোও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো হিসেবেই পরিচিত। টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে সরিয়ে নাকতলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের জায়গা নেন অর্পিতা৷ 

অর্পিতার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চোখ রাখলে দেখা যায়, বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন অভিনেত্রী। বেশ কয়েকবার বিদেশ সফরও করেছেন৷ অথচ গত কয়েক বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করেননি তিনি৷ এর পরেও বিলাসিতার এই বিপুল অর্থ কোথা থেকে আসত? কে জোগাত? অভিনেত্রীর মা মিনতির কথায়, মেয়ে কী করে জানা নেই তাঁর৷ জানতেন না অগাধ সম্পত্তির কথাও৷