কলকাতা: ‘অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি’র আহ্বানে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ বাতিলের দাবিতে সারা ভারত প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে কলকাতা প্রেস ক্লাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রত্যাহারের দাবিতে সারা রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন ও রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে বলে জানানো হয়। ‘অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অনিশ রায় ও কোষাধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ মিত্র, সারা বাংলা ‘সেভ এডুকেশন কমিটি’র সভাপতি প্রাক্তন উপাচার্য চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী ও রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক তরুণ কান্তি নস্কর এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
আজ এই অনুষ্ঠান থেকে তারা বলেন, করোনা অতিমারির সুযোগে সংসদকে এড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গত বছর ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ চালু করেছিল। এ বিষয়ে দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী সহ সর্বস্তরের মানুষের তীব্র প্রতিবাদের কোন মূল্য তারা দেয়নি। নয়া নীতি চালু করার পর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তারা শিক্ষায় একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা সহ নবজাগরণের ধারায় প্রাপ্ত আধুনিক শিক্ষার সমস্ত ধ্যান ধারণাকে নস্যাৎ করতে চলেছে। পূর্বতন শাসকদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শিক্ষার যতটুকু অবশেষ আজও টিকে আছে তাকেও তারা সমূলে উৎপাটিত করতে উদ্যত। এই শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষাকে ‘অধিকার’-এর পরিবর্তে কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থে পুরোপুরি বাজারের পণ্যের পরিণত করা। তাই পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকার কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চলেছে, যাতে সেখান থেকে তারা সর্বোচ্চ মুনাফা লুঠতে পারে। শিক্ষায় বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ আজ লাগামছাড়া। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যেখানে ভর্তি হতে বিপুল পরিমাণ টাকা গুনতে হবে। বাকিদের জন্য রয়েছে পরিকাঠামোহীন অঙ্গনওয়াড়ি ও দুর্বল পরিকাঠামোর স্কুল কলেজের শিক্ষা। অপরদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে এমন শিক্ষা প্রবর্তন করতে, যেখানে শিক্ষার মূল প্রাণসত্তা অর্থাৎ মানুষ তৈরির শিক্ষা বলে কিছু থাকবে না। যথার্থ বিজ্ঞানমনস্ক, উন্নত চিন্তা সমৃদ্ধ, আধুনিক মানুষ তৈরির পরিবর্তে এমন মানুষ সেখানে তৈরি হবে, যারা অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতাকেই প্রাধান্য দেবে। চিন্তায় চেতনায় তারা পড়ে থাকবে মধ্যযুগে। তারই আয়োজন চলছে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ ঘটিয়ে। ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’-এর নামে নানা ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা, পৌরাণিক কাহিনীর মতো বিষয় সিলেবাসে ঠাঁই পাচ্ছে। আরএসএসের চিন্তার ছাঁচে ইতিহাসকে নতুন করে লেখা হচ্ছে। বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার পরিবর্তে গোবরের ঔষধি-গুণ, জ্যোতিষশাস্ত্র, বৈদিক বিমান প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা প্রাধান্য পাচ্ছে।
পাশাপাশি তারা আরও জানান, অনলাইন শিক্ষার পরিধি বাড়াতে ইউজিসি সাম্প্রতিক নির্দেশিকায় উচ্চশিক্ষায় ন্যূনতম ৪০ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। এরই নাম ‘ব্লেন্ডেড মোড’। এই অনলাইন শিক্ষার বাজার ধরতে কর্পোরেট মালিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে এতদিনকার প্রথাগত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা বিপন্ন, হারিয়ে যেতে চলেছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। তাছাড়া অনলাইন শিক্ষার পরিধি বাড়লে তার সুযোগে সরকারও নানারকম দায় এড়াবার সুযোগ পাবে। কারণ অনলাইন শিক্ষায় নতুন স্কুল-কলেজ স্থাপনা ও শিক্ষক নিয়োগের কোন প্রয়োজন থাকবে না। শিক্ষায় গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের কোনো অস্তিত্বই কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষানীতিতে অবশিষ্ট রাখেনি। শিক্ষা যে যুগ্ম-তালিকাভুক্ত একথা তারা ভুলে গিয়েছেন। এমনকি উচ্চশিক্ষায় ভর্তির প্রক্রিয়াকেও কেন্দ্রীয়ভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করবে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির মারফত। দ্রুততার সাথে জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করার জন্য দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে NEP-Cell গড়ে তুলতে ইউজিসি উপাচার্যদের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে তারা রাজ্যকে নিশানা করে বলেছেন, এই রাজ্যের সরকার নানা প্রশ্নে কেন্দ্রের বিরোধিতা করলেও শিক্ষায় কেন্দ্রের নয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা সম্পূর্ণ নীরব থেকে বরং সেগুলিকে রাজ্যে কার্যকর করতে নানাভাবে সাহায্য করছে। সর্বোপরি জানান হয়েছে, তারা এই আন্দোলনকে দেশের সর্বত্র একেবারে তৃণমূল স্তরে পর্যন্ত পৌঁছে দিতে আগামী ৮ ডিসেম্বর সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করবেন। ঐ দিন রাজ্যপালের কাছেও এক প্রতিনিধি দল গিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করবে। আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, সর্বভারতীয় সম্পাদক অধ্যাপক অনীশ রায়, অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার, সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর, বিশ্বজিৎ মিত্র ও অন্যান্যরা।