বহরমপুর: আচমকাই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল৷ ওলট-পালট হয়ে গেল যাবতীয় সমীকরণ৷ ভিন রাজ্য বা ভিন জেলায় আটকে পড়া মানুষের দল ঘরে ফিরতে শুরু করল মাইলের পর মাইল পথ চলা৷ লকডাউন শুরু হতেই সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের এই অসম লড়াইয়ের ছবি৷ কেউ কেউ আবার পরিবার থেকে বহু দূরে পড়ে রইলেন কাজের জায়গাতেই৷ কিন্তু সন্তানের টানে দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ি ফেরার দৃষ্টান্ত, হয়তো খুব কমই রয়েছে৷
লকডাউন শুরু হওয়ার পর বোলপুরেই থেকে গিয়েছিলেন বালুরঘাটের পরিযায়ী শ্রমিক বিশ্বজিৎ দাসরায়৷ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে শুধুই ফোন কল৷ কিন্তু ফোনের ওপার থেকে মেয়ে যখন বাবা বলে কেঁদে উঠত, তখন বুক ফেটে যেত তাঁর৷ মেয়ের কান্না শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল একরত্তি মেয়েটার সেই মিষ্টি হাসি। মেয়েকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তিনি৷ কিন্তু বাড়ি ফিরবেন কী করে? সব যে বন্ধ৷
কোনও উপায় না পেয়ে তাই মরিয়া হয়েই বোলপুর থেকে পায়ে হেঁটে বালুরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বিশ্বজিৎবাবু৷ টানা পাঁচ দিন ধরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ হাঁটার পর মালদহ সীমানায় পৌঁছন তিনি৷ সেখানেই গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেওয়া৷ কিন্তু বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিলে চলবে না৷ কারণ, পথ চলা যে এখনও অনেক বাকি৷
প্রখর রৌদ্রে নাওয়া-খাওয়া নেই৷ শুধু মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা৷ বিশ্বজিৎবাবুর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ৷ ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে৷ কিন্তু, দু’চোখের পাতা এক করার ফুরসত নেই তাঁর৷ যত শীঘ্র সম্ভব মেয়ের কাছে পৌঁছতে হবে যে৷ গলায় জড়ানো গামছা দিয়ে ঘাম মুছে ফের এগিয়ে চললেন তিনি৷
বছর ৩৫-এর বিশ্বজিৎবাবু জানান, বোলপুরে দূর সম্পর্কের এক দাদার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি৷ সেখানে একটি সংস্থায় শ্রমিকের কাজ করতেন। লকডাউন হওয়ায় আপাতত কাজ বন্ধ৷ তিনি বলেন, একমাস হয়ে গিয়েছে৷ বাড়ি যেতে পারিনি। ফোন করলেই ছোট্ট মেয়েটা আমাকে দেখার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। ওর বয়স মাত্র তিন বছর৷ ওকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠছিল৷ তাই কোনও কিছুর পরোয়া না করেই বেরিয়ে পরি৷ রাস্তায় এক প্যাকেট বিস্কুট আর জল খেয়ে কাটিয়েছি।
সারা দিন হাঁটার পর রাতে একটু বিশ্রাম নেওয়া৷ বিশ্বজিৎবাবু বলেন, রাতের অন্ধকারে জাতীয় সড়ক ধরে হাঁটতে গা ছমছম করে। তাই অন্ধকার নামলেই কখনও গাছের তলায় বা কখনও যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিই। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আবার হাঁটতে শুরু করি। রাতে মশার কামড়ে ঘুম হয় না৷ কিন্তু তাতেও হাল ছাড়ব না৷ মেয়েকে না দেখা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই৷
তিনি বলেন, এদিনও একজনের ফোন থেকে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। মেয়েকে বলেছি মাঝ রাস্তায় চলে এসেছি। আর কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাব৷ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সব জ্বালা জুড়াবে আমার৷