কলকাতা: শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এ বার সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য। কিছু দিন আগেও নিজের কলকাতার ফ্ল্যাটের ছাদে দাঁড়িয়ে এই সুবীরেশই দাবি করেছিলেন, তাঁর আমলে কোনও নিয়োগ দুর্নীতি হয়নি। পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে। এর বেশি কিছু নয়৷ সোমবার সেই বাঁশদ্রোণীর ফ্ল্যাট থেকেই গ্রেফতার করা হল সুবীরেশ ভট্টাচার্যকে৷ যিনি কিনা শুধু এসএসসি’র চেয়ারম্যানই ছিলেন না৷ ছিলেন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাজ্যের উপাচার্য পরিষদের সম্পাদক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য, কলকাতার একাধিক কলেজের পরিচালন কমিটির সভাপতি সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদের অধিকারী৷ তাঁর উত্থান কোনও চিত্রনাট্যের চেয়ে কম নয়৷ ভিনরাজ্য থেকে আসা একজন অধ্যাপক কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার অলিন্দে রাজত্ব কায়েম করলেন সেই জবাব পেতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা৷ আর সেই তথ্য তালাশে নেমেই উঠে এল একের পর এক চাঞ্চল্যকর কাহিনি৷
সিপিএম-এর যোগসূত্রেই ত্রিপুরা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন সুবীরেশ। একদা আলিমুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন তিনি৷ কিন্তু, রাজ্যে পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে লাল ছেড়ে সবুজে ঝাঁপ দেন সুবীরেশ৷ হয়ে ওঠে ঘাসফুল শিবিরের প্রিয়পাত্র৷ অনেকেই মনে করেন, শাসক দলের প্রতি সুবীরেশের একনিষ্ঠ আনুগত্যই তাঁর উত্থানের জিওনকাঠি৷ সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু৷ শিক্ষামহলের একাংশের অভিযোগ, ক্ষমতার থাকতে যখন যেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন সেখানেই নিয়ম ভেঙে কাছের লোকজনকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন সুবীরেশ৷
তৃণমূল বিধায়ক তথা পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের হাত ধরেই কাস্তে হাতুড়ি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন এসএসসির এই প্রাক্তন চেয়ারম্যান। এই মানিক আবার ছিলেন বাম আমলে ওয়েবকুটার শীর্ষস্থানীয় নেতা৷ দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ সমিতির দায়িত্বও সামলেছিলেন তিনি। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর টুক করে জোড়া ফুল হাতে তুলে নেন সিপিএমের ‘গুডবয়’৷ সঙ্গে নিয়ে আসেন আরও দু’জনকে৷ তাঁদের মধ্যে একজন সুবীরেশ।
মানিকের সূত্রেই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। ব্রাত্যর বদান্যতায় ২০১৩ সাল থেকে শিক্ষা দফতরের পাশাপাশি কলকাতার বিভিন্ন কলেজের পরিচালন কমিতিতে জায়গা করতে থাকেন সুবীরেশ৷ ওই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও সিন্ডিকেটের সদস্যও হন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কমিটির সদস্য হওয়ার পর কার্যত আর পিছু ফিরে চাননি সুবীরেশ। ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্মানিক ডি-লিট প্রদান করা হয়৷ যা নিয়ে দেশজুড়ে কম বিতর্ক হয়নি।শোনা যায়, ২০১৮ সালে মমতাকে ডি-লিট দেওয়া হলেও, সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল সুবীরেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ার পর থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পেরিয়ে সেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল কালীঘাটের অন্দরে। অনেকেই মনে করেন, এর পুরস্কার স্বরূপ ২০১৪ সালে সুবীরেশ পেয়েছিলেন এসএসসির চেয়ারম্যান পদ। ২০১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সবথেকে বড় কমিটি সেনেটের সদস্যও হন তিনি। তারপরেই তাঁর প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে এবং ডি-লিট উপাধি দেওয়া হয় মমতাকে।
২০১৮ সালের শুরুতেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসেন সুবীরেশ। তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে তেমন পাত্তা পাননি৷ পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্যেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। মাঝে এসএসসি-র চেয়ারম্যানের পদ থেকে সুবীরেশকে সরিয়ে দিয়েছিলেন পার্থ৷ সে সময় মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পদে ফিরে পেয়েছিলেন সুবীরেশ৷
অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পরও কলকাতাতেই নাকি অধিক সময় কাটাতেন তিনি। কলেজ সার্ভিস কমিশনেও সুবীরেশের যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলে জানতে পেরেছে সিবিআই। তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের প্রভাবশালী নেতা গৌতম দেবের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। যোগাযোগ ছিল দলের সকল প্রভাবশালী নেতার সঙ্গেই।
উল্কার গতিতে সুবীরেশের এই উত্থান নজর এড়ায়নি সিবিআই-এর গোয়েন্দাদের৷ তথ্য তলাশে খতিয়ে দেখা হচ্ছে তাঁর ফোন৷ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নতুন তথ্য উঠে আসতে পারে বলেই মনে করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা৷
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>