কলকাতা: বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্রপতন৷ আপামর দর্শককুলকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তাদের প্রিয় ফেলুদা৷ প্রয়াত হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর৷ কোভিডে সংক্রমণের পর মধ্য কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় বর্ষীয়ান অভিনেতাকে। গত শুক্রবার থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তবে দ্বিতীয়বার প্লাজমা থেরাপির পর সৌমিত্রর অবস্থার উন্নতি লক্ষ করা যায়। যদিও এ দিনের মেডিক্যাল বুলেটিন জানা গিয়েছিল, প্রবীণ অভিনেতার অস্থিরতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বিভ্রান্ত এবং উত্তেজিতও হয়ে পড়ছেন তিনি৷
শুধুই অসামান্য অভিনেতা নন, তাঁর সঙ্গে তিনি ছিলেন নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি৷ জীবনের ৮৪টি বসন্ত তিনি পার করেছেন সাফল্যের মু্গ্ধতায়৷ ৫৯ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কাজ করে যাচ্ছিলেন এখনও৷
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠাকুরদার আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন৷ পিতৃদেবের চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর স্কুল বদল হতে থাকে৷ বিদ্যালয়ের পড়াশোনা তিনি শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে৷ তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে৷ প্রথমে আইএসসি এবং পরে বাংলা সাহিত্য নিয়ে স্নাতক পাস করেন৷ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এও দু-বছর পড়াশোনা করেন৷ ছাত্রজীবনেই নাটকে অভিনয় শুরু। কলেজ জীবনে অহীন্দ্র চৌধুরী ও পরবর্তী সময়ে নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির সান্নিধ্যে এসে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন সৌমিত্র৷
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই রূপোলী পর্দায় অভিষেক হয় সৌমিত্রর৷ ১৯৫৮ তাঁকে প্রথম দেখা যায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি৷ সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথের পর হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় ‘ফেলুদা’৷ পাশাপাশি অরণ্যের দিনরাত্রি, হীরক রাজার দেশে আজও বাঙালীর নস্টালজিয়া৷ একে একে মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেন তিনি৷ পুনশ্চ, ঝিন্দের বন্দী, সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, তিন ভুবনের পারে আজও বারবার দেখেন তাঁর ভক্তকুল৷
২০০৪ সালে পদ্মভূষণে ভূষিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ ২০১২ সালে পান ভারত সরকারের দাদা সাহেব ফালকে৷ ২০১৭ সালে ফ্রান্স সরকার লিজিঅন অব অনারে ভূষিত করেন তাঁকে৷ ওই বছরই বঙ্গবিভূষণে ভূষিত হন অভিনেতা৷ কিছুবছর আগে তাঁর অভিনীত ‘বেলাশেষে’ দেখে চোখের কোনে জল এসেছিল বাঙালীর৷ নিজের অভিনয় প্রিতীর কথা জানিয়ে সৌমিত্র গেল বছর ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘সেই শৈশব কাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ।’ তাঁর নিপুন অভিনয়- সেই কন্ঠস্বর বাঙালীর হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে৷ বাঙলা চলচ্চিত্রে কালজয়ী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অমর হয়ে থাকবেন বাঙালীর স্মৃতিতে৷