সিভিক ভলেন্টিয়ারদের চাকরি নিয়ে টানাটানি! পুলিশের সমকক্ষ? রাজ্যের এই বাহিনীর আসল কাজ কী জানুন

কলকাতা: আরজি কর কাণ্ডের জন্য এবার সিভিক ভলেন্টিয়ারদের চাকরি নিয়ে টানাটানি?বড় নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের!মুখে মুখে ফিরছে একই অভিযোগ,মাত্র ৭ দিনের ট্রেনিং এই এতো?হাবভাব এমন, যেন…

Picsart 24 09 20 04 17 47 845

কলকাতা: আরজি কর কাণ্ডের জন্য এবার সিভিক ভলেন্টিয়ারদের চাকরি নিয়ে টানাটানি?বড় নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের!মুখে মুখে ফিরছে একই অভিযোগ,মাত্র ৭ দিনের ট্রেনিং এই এতো?হাবভাব এমন, যেন সিভিক ভলেন্টিয়াররা পুলিশের উপরে!

প্রথমেই জানা উচিৎ, সিভিক পুলিশ নয়। সিভিক ভলান্টিয়ার। ‘পুলিশ’ তকমা উঠে গেলেও এখনও অনেকে ‘সিভিক পুলিশ’ বলেই ডাকেন। আর কারো কারো অভিযোগ, পুলিশ না হয়েও হাবেভাবে কীর্তিকলাপে সিভিক ভলেন্টিয়াররা যেন পুলিশ ফেইল! এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডে ধর্ষণ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের গ্রেফতারির পর তার একেকটা কীর্তি যখন সামনে আসতে শুরু করল, তখন ফের একবার গোটা রাজ্যের সিভিক ভলেন্টিয়ারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল সব মহলে। এমনকি চিকিৎসক, নার্সিং স্টাফ সহ অন্যান্য কর্মীদের সেফটি সিকিউরিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে কারণ আরজি কর হাসপাতালে কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী হিসেবে কাজ করত সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়। আর তাই আরজি কর মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টে চিকিৎসক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উঠতেই

হাসপাতালে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন কেন সেই বিষয়ে সওয়াল করেন জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ।

আরজি কর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের কথাও কোর্টে তোলা হয়। চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকলে নিরাপত্তা কি সত্যিই বজায় থাকবে? সেক্ষেত্রে আদৌ কী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের সুরক্ষিত মনে করবেন, সেই নিয়েও সওয়াল করেন আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ।প্রশ্ন ওঠে সাত দিনের ট্রেনিং দিয়ে কী ভাবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ করা হয়? এতো কম সময়ের প্রশিক্ষণে সত্যিই কী তাদের থেকে উপযুক্ত নিরাপত্তার আশা করা যায়? সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় রাজ্য সরকারকে। প্রধান বিচারপতির মন্তব্য এক্ষেত্রে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। “ওই চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের কী ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োগ করতে পারে রাজ্য? রাজ্যের এই বিষয়ে ভাবা উচিত।”
সত্যিই তো সিভিক ভলেন্টিয়ারদের এতো ক্ষমতা, এতো পাওয়ার, কখনও কখনও সিভিক ভলেন্টিয়ারদের জন্য প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে রাজ্য পুলিশকেও। এবারের আরজি কর কাণ্ডেও ঘটেছে সেই একই ঘটনা। এমনকি প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল সাংবাদিক বৈঠকে যে সঞ্জয় রায় সিভিক ভলেন্টিয়ার, সেই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন অভিযুক্তের পরিচয় শুধু অভিযুক্ত। সেটা নিয়েও কলকাতা পুলিশকে কম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। তারপর তো আছেই সঞ্জয় এর প্রভাবশালী তত্ত্ব। পুলিশ মহলের সঙ্গে দহরম মহরম। না শুধু সঞ্জয় নয়। সিভিক ভলেন্টিয়ারদের এমন প্রভাব, পুলিশ মহলের সঙ্গে ওঠাবসা এটা কিন্তু গোটা রাজ্যের ছবি। আর এই অভিযোগ আজকের নয়। এর আগেও সিভিক ভলেন্টিয়ারদের নিয়ে নানান অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের সঙ্গে থাকতে থাকতে সিভিক ভলান্টিয়াররা যে অনেকে নিজেদের পুলিশের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেন, তার নজিরও বাংলায় বড় কম নেই। আনিস খান হত্যাকাণ্ড তো অনেক বড় বিষয়, আরও বহু বিতর্কে জড়িয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নাম। কিন্তু প্রশ্ন হল সিভিক ভলেন্টিয়ারদের এতো কীর্তি সামনে আসার পরেও রাজ্য সরকারের তরফে তাদের বোনাস বাড়ানো, অবসরকালীন সুবিধা বাড়ানো। এগুলো কতটা যুক্তিসঙ্গত? এগুলোর কী সত্যিই দরকার ছিল? এই প্রশ্ন আমজনতার। এর আগে হাইকোর্টেও রাজ্য সরকার সিভিক ভলেন্টিয়ারদের জন্য প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। কিন্তু তারপরেও এই বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনরকম পদক্ষেপ করা তো দূরস্ত, উল্টে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে সিভিক ভলেন্টিয়ার দেরকে বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পালা।

বাম জমানায় এ রাজ্যে কিন্তু সিভিক ভলান্টিয়ার ছিল না। তবে ২০০৮ সালে কলকাতায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরসভা ‘গ্রিন পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল। যদিও বাহিনী তৈরির মূল উদ্যোগ শুরু হয় ২০১২ সালে। এদের নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। বিরোধীরা রাজ্য সরকারের এই বাহিনীকে শাসক তৃণমূলের ‘ইউনিফর্ম পরা ক্যাডার’ বলেও অনেক সময় দাবি করেছেন।

সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে পুলিশবাহিনীতেও আলোচনা শুরু হয়েছিল। মূল আপত্তি ছিল বাহিনীর নামে ‘পুলিশ’ শব্দটি নিয়ে। অন্য দিকে, নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সেই সময় সরব হতে শুরু করেছিল সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ারদের সংগঠন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর নাম থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে দেয় রাজ্য সরকার। ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স’ শুধু ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’ হয়ে যায়।

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বাহিনী তৈরির সময়ে যা ভাবনা ছিল, তাতে পুলিশের ‘সাহায্যকারী’ হিসেবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করেছিল রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। ছ’মাস অন্তর ওই চুক্তির পুনর্নবীকরণ হওয়ার কথা। এঁদের দায়িত্ব মূলত যানশাসন ও মেলা-পার্বণে ভিড় সামলানো। নবান্নের তরফে বলা হয়েছিল, জেলা স্তরে কমিটি তৈরি করে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স বাছাই করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলেই চলবে। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে অষ্টম শ্রেণি পাশ। প্রত্যেককে মাসে অন্তত ২০ দিন কাজ দিতেই হবে। সুযোগ তাঁরাই পাওয়ার কথা যাঁদের নাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুপারিশ করবেন। এই দায়িত্ব মূলত থাকে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের উপরে। তিনি আবার সুপারিশের জন্য নির্ভর করবেন যে থানা এলাকায় ওই সিভিক ভলান্টিয়ার কাজ করছেন, সেখানকার ওসি এবং এসডিপিও-র রিপোর্টের উপরে। যে থানার অধীনে নিয়োগ হবে, সংশ্লিষ্ট সিভিক ভলান্টিয়ার সেখানকারই বাসিন্দা কি না, তা-ও দেখা হয়। তবে পাশাপাশি বলে দেওয়া হয়, যাঁরা এই কাজ পাবেন, তাঁরা কোনও ভাবেই নিজেদের ‘স্থায়ী সরকারি কর্মী’ হিসাবে দাবি করতে পারবেন না। সিভিক ভলান্টিয়ার হতে গেলে দু’সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণও নিতে হয়। অনলাইন নয়, অফলাইনেই আবেদন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়। কিন্তু তারপর? গত বছর সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে আর কোনও প্রশাসনিক কাজ নয়। হাইকোর্টের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়। সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ কী, তা নির্দেশিকা দিয়ে বেঁধে দেয় রাজ্য পুলিশ। সেইসময় হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিল রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সিভিক ভলান্টিয়ারদের কী ভূমিকা? আর এবার তো সঞ্জয় রায়ের ঘটানো অপরাধ হাতেনাতে প্রমাণ দিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিক ভলেন্টিয়ার আসলে কতটা তৎপর। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা গোটা হাসপাতালে কাজ করবে। চিকিৎসক, বিশেষত মহিলা চিকিৎসকরা কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত মনে করবেন? কর্মশক্তির একটা বড় অংশই তরুণী। তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। এদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে রাজ্যকে। জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারকে মহিলা সহ সমস্ত ডাক্তারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।” চিকিৎসকদের সংশয় ন্যায়সঙ্গত, নিরাপত্তার প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক এই মন্তব্যও করেছেন প্রধান বিচারপতি। এরপরেও রাজ্যে সিভিক ভলেন্টিয়ারদের গুরুত্ব বা কাজ একই থাকে কিনা, সিভিক ভলেন্টিয়ারদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো পদক্ষেপ করে কিনা মমতা সরকার। সেটাই দেখার অপেক্ষা।