কলকাতা: জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে রাজনীতি লুকিয়ে কোথায়?মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোক্ষম কথাটা বলেই দিলেন?ভিডিওতেই লুকিয়ে আসল রহস্য!কুণাল, কল্যান থেকে চন্দ্রিমা;’পলিটিক্স’ পেলেন প্রত্যেকে।সিপিএম নাকি বিজেপি,এই আন্দোলনের নেপথ্যে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে?
সূত্রপাত, হাল্কা হলুদ রংয়ের পোশাক পরা মহিলাকে সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে থাকতে দেখা যায়। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এক্স হ্যান্ডলে একটা ভিডিয়োটা পোস্ট করে প্রশ্ন তোলেন, “এটা কোথাকার ছবি? ইনি কে? সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ঘুরছে, তা কি ঠিক? ইনি যদি তিনি হন, তা হলে ইনি এখানে কেন? ইনি এলেন, না ডাকা হল? ডাকা হলে কেন হল? যদি কেউ স্পষ্ট করে ঘটনাস্থল এবং চরিত্রগুলি জানাতে পারেন, পোস্ট করবেন প্লিজ। আমি কনফিউজড।”
পরে কুণাল-ঘনিষ্ঠরা দাবি করেন, হাল্কা হলুদ রঙের পোশাক পরা মহিলা পামেলা গোস্বামী। যে পামেলা কয়েক বছর আগে বিজেপি নেত্রী থাকাকালীন মাদক পাচারের অভিযোগ গ্রেফতার হয়েছিলেন। এরপর এই নিয়ে কুণাল এবং পামেলার এক্স পোস্টের ‘যুদ্ধ’ চলতে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিজেপি নেত্রী জুনিয়র চিকিৎসকদের ধর্না অবস্থান ঠিক কী করছিলেন?
এমনিতে তো জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের কর্মসূচিতে প্রথম থেকেই রাজনীতির রং লাগাতে চাননি বলে আন্দোলনকে জোরদার করতে রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজের সঙ্গীদের নিয়ে এক সময় গঠন করেন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট। সমস্ত দোষীকে চিহ্নিত করে ন্যায্য বিচার, কলকাতা নগর পালের পদত্যাগ সহ কয়েকটা দাবিতে জুনিয়ার চিকিৎসকদের আন্দোলন কর্ম বিরতি আজও চলছে। কিন্তু প্রতি মূহুর্তে তাঁরা একটাই বিষয় প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের এই আন্দোলন প্রতিবাদের বিন্দু বিসর্গও যোগ নেই। অথচ, ভিডিও কিন্তু অন্য কথা বলছে, মত বিশ্লেষকদের একাংশের।
তাছাড়া, রাজ্য সরকার যখন বারংবার নবান্নে ডেকে খোলা মনে আলোচনার কথা উল্লেখ করেছে, তখনও একেকবার একেক বিষয়ে নিজেদের প্রত্যেকটা শর্তে অনড় থাকতে দেখা গেছে জুনিয়র চিকিৎসকদের। যা দেখে জুনিয়র চিকিৎসকদের অনড় মনোভাবের পিছনে রাজনৈতিক যোগ আছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও৷ বলছিলেন, “কোনও শর্ত দিয়ে খোলা মনে বসা যায় না। আসলে এর পিছনে রাজনীতির খেলা আছে। আমরাও চাই মেয়েটি বিচার পাক৷ আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে মান্যতা দেব। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু নেতিবাচক পদক্ষেপ করেননি। রোগীদের বঞ্চনা করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।”
এমনকি একের পর এক টালবাহানার পর নবান্নে নির্ধারিত সময়ের পরে পৌঁছলেও, নিজেদের ৩০ থেকে ৩২ জন প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেও, রাজ্য সরকার সবটাই মেনে নেয়। কিন্তু, চিকিৎসকদের একটা শর্তের সামনে অবশেষে বৈঠক ভেস্তে যায়। বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে এটাই ছিল জুনিয়ার চিকিৎসকদের বড় দাবি। নো স্ট্রীমিং নো ডিসকাশন, এই দাবির সামনে কার্য তো, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর। এই পয়েন্টটা মানতে চায়নি, রাজ্য সরকার। দীর্ঘ ২ ঘণ্টারও বেশি সময় সভা ঘরে অপেক্ষা করে বসে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে নবান্নে পৌঁছে পাশ থেকে নামার পর এই লাইভ ট্রেনিং নিয়ে নিজেদের মধ্যে পরপর জিবি মিটিং চালাতে থাকেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। চরমে ওঠে জুনিয়র চিকিৎসক বনাম রাজ্য সরকারের স্নায়ুযুদ্ধ। অবশেষে সাংবাদিক বৈঠক করে নবান্ন ছাড়েন মুখ্যমন্ত্রী। বাতিল হয় বৈঠক। কিন্তু এই দীর্ঘ ২৩ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন সেখানেও জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে রাজনীতির ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী বলেন “আমি খোলা মনে আলোচনার কথা বলেছিলাম। তাঁরা যে কোন বিষয়ে তুলে ধরতে পারতেন। তারপর সংবাদমাধ্যমকে জানাতেন। বৈঠক ইতিবাচক হলে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করতাম। কিন্তু কয়েকজন চেয়ার চায়, বিচার না। আমি শুনলাম ওঁদের মধ্যে সবাই নয় কেউ কেউ দু তিনজন এই বৈঠক করতে চাইছে না। ওঁদের কাছে বাইরে থেকে নির্দেশ আসছে।”
অতএব ‘চেয়ার’ এর কথা বলে এদিন মুখ্যমন্ত্রীও একটা বিষয় ছুঁয়ে যান সেটা হল রাজনীতি। এমনকি শেষে তিনি এটাও বলেন মানুষের স্বার্থে তিনি পদত্যাগ করতেও প্রস্তুত। তিনি চেয়ার চাননা।
কিন্তু এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই যে প্রশ্নটা তুলেছেন, সত্যিই তো। নবান্নে দাঁড়িয়ে বাসের আড়াল থেকে কাদের বুদ্ধি নিলেন চিকিৎসকেরা? তাহলে কি বাইরে থেকেই আন্দোলনকে পরিচালনা করা হচ্ছে? সত্যিই কি এতে পলিটিক্স আছে?
যদিও রাজ্যের তরফে বারংবার ওঠা রাজনীতির রঙের অভিযোগ এর
পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক করে পড়ুয়ারা জানান, আন্দোলনে কোনও রাজনীতি নেই। এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন বলেও দাবি করেন তাঁরা। সঙ্গে বলেন, তাঁদের আন্দোলনের পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক৷
বরং যাঁরা তাঁদের আন্দোলনে রাজনীতি দেখছেন, তাঁরাই আসলে রাজনীতি করছেন বলে রাজ্য সরকারকে জবাব দিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের।
তবে এত কিছুর পরেও জট কাটেনি। সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং জুনিয়র চিকিৎসকদের একজনও সাসপেন্ড হলে ওপিডি ওয়ার্ক তুলে নেওয়া হবে বলে রীতিমত হুমকি দিয়েছেন সিনিয়র চিকিৎসকরা। সাধারণ মানুষের একাংশ বলছেন চিকিৎসকরা বুঝে গিয়েছেন এখন তাদের কোর্টেই বল। আর তাই রাজনীতির খেলায় নেমেছেন।
চুপ থাকেন নি হুমায়ুন কবীর ও। মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবির আন্দোলনরত চিকিৎসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, “পাবলিক যদি মরে তাহলে ডাক্তাররা কেন নিরাপদে থাকবে?” আর তার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই, শ্রীরামপুরের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি আজ যে ডাক্তাররা সুপ্রিম কোর্টে বলার পরেও কাজে যোগ করল না তাঁদের মানসিকতা খুব পরিষ্কার। তাঁরা তাঁদের ইগো, তাঁদের গোঁ নিয়ে চলছেন। তাঁরা বাংলার মানুষের সেবা করতে আসেননি। পরিষেবা দিতে আসেননি। এরা ডাক্তার হওয়ার আনফিট। যাঁরা একমাসের বেশি সময় ধরে স্ট্রাইক করে ট্রিটমেন্ট দেননি। তাঁদের ডাক্তার করা উচিত নয়। আমি সরকারের কাছে আবেদন করব যে এদের ডাক্তারি পরীক্ষায় বসতে দেওয়া উচিত নয়। এই স্ট্রাইক অবৈধ। যে দুর্নীতি ধরা পড়েছে তার বিচার হবে। যেখানে যে দুর্নীতি করছে তার বিচার হবে। কিন্তু, তা বলে এই নয় ডাক্তাররা যে অমানবিক কাজ করেছে, ডাক্তাররা যে স্ট্রাইক করেছে তা অসাংবিধানিক। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা ভারতবর্ষের সংবিধানে ২১ ধারাকে লঙ্ঘিত করছে।”
আন্দোলনের সময় বাড়ছে। চিকিৎসকরা কর্ম বিরতি থেকে সরছেন না। আর এই পরিস্থিতিতে যত রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে ততই জল ঘোলা বাড়ছে জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ঘিরে। কিন্তু এমন মোক্ষম সময় সব থেকে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে প্রশ্নটা। রাজ্য সরকারের তরফে ওঠা এই রাজনীতির রং নিয়ে যে অভিযোগ উঠছে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন কে কেন্দ্র করে, এবং যেসবের ভিত্তিতে এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেগুলোর সবটাই কি মিথ্যে? চোখের ভুল? কৌতুহল বাড়ছে রাজ্যবাসীর মনে।