শিল্পের স্বপ্ন বুকেই থেকে গেল… কোন ভুল করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য?

কলকাতা: সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম, কারখানার স্বপ্ন বুদ্ধদেবের চোখেই থেকে গেল!শিল্পের বাস্তবায়নে আদতে কোথায় ভুলটা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য?সেই টাটা গোষ্ঠীর পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়া,বড় প্রশ্ন।তারপর ঠিক কতগুলো…

mb

কলকাতা: সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম, কারখানার স্বপ্ন বুদ্ধদেবের চোখেই থেকে গেল!শিল্পের বাস্তবায়নে আদতে কোথায় ভুলটা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য?সেই টাটা গোষ্ঠীর পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়া,বড় প্রশ্ন।তারপর ঠিক কতগুলো শিল্পের মুখ দেখেছে আমাদের বাংলা?

বাংলায় শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কারিগর আজ চিরনিদ্রায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝেছিলেন আসল সারমর্মটা। তাই তো বার বার তাঁর গলায় শোনা গেছে, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। সেই শিল্পের জন্য তিনি ইনিশিয়েটিভ নিয়েছিলেন বটে। কিন্তু সেই উদ্যোগ একসময় মুখ থুবড়ে পড়ল।

মনে আছে? সাল ২০০৬। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সপ্তম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শিল্পস্থাপনে উদ্যোগী হন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব। সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা, নয়াচরে কেমিক্যাল হাব-সহ একাধিক কারখানা গড়ার উদ্যোগ। আসলে এই বামনেতা বুঝতেন, উচ্চশিক্ষিত যুব সমাজের ভবিষ্যতের জন্য শিল্পের গুরুত্ব টা কী বা কোথায়।
সেই কথা রাজ্যের মানুষকে তিনি কমবার তো বোঝানোর চেষ্টাও করেননি। নতুন শিল্প এলে, রাজ্যে কর্মসংস্থানের যে জোয়ার আসবে সে বিষয়েও তিনি আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু নিজের জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেখে যেতে পারলেন না তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেও তা বাস্তবায়নে বেশ কিছু ভুল ছিল রাজ্যের প্রাক্তন বাম মুখ্যমন্ত্রীর।

টাটার ন্যানো কারখানা তৈরির জন্য সেইসময় বেছে নেওয়া হয় হুগলি জেলার সিঙ্গুরকে। সিঙ্গুরের পাশাপাশি নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি শালবনিতে ইস্পাত কারখানা, কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগও নেয় বুদ্ধদেব সরকার। কলকাতার উপকণ্ঠে তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র গড়তেও প্রথম সারির অনেক তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

কিন্তু ফাঁক থেকে গেছিল চিন্তায়। সিঙ্গুরে এবং নন্দীগ্রামে ‘জোর করে’ কৃষিজমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা চরমে উঠেছিল। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সিঙ্গুরের বহুফসলি জমি নিয়ে স্থানীয়দের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। যে সমস্যা সমাধানে দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি বুদ্ধদেবের প্রশাসন। তাছাড়া, সেই পরিস্থিতিতে যে ‘ঔদ্ধত্য’ বুদ্ধদেব দেখিয়েছিলেন, তাতে হিতে বিপরীত হয়। বিরোধীদের আন্দোলনে শেষমেশ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে গুজরাটে চলে যায় টাটা গোষ্ঠী। নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব নিয়েও একই পরিস্থিতি। সেখানেও একাংশ বাম নেতাদের উস্কানিমূলক কথাবার্তায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েক জনের প্রাণ হারানোর অভিযোগও ওঠে। আর এই যে একের পর এক ঘটনা, এত কিছুর পরেও নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেননি তিনি। এটা ফ্যাক্ট যে জমি সংক্রান্ত আন্দোলন থেকেই দুর্বল হতে থাকে বামফ্রন্টের আগল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই বিতর্ক তাড়া করতে শুরু করেছিল বুদ্ধদেবকে।
ধাক্কা আরও বৃহদাকার ধারণ করে ২০০৯ লোকসভা ভোটে। আর, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৩৪ বছরের বাম সরকারের অবসান হয়।
আর এটা ৮ থেকে রাশি সবাই জানে, বুদ্ধদেবের সরকারের পতনের পর থেকেই রাজ্যে নতুন শিল্প তৈরির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা নিশ্চিত ভাবে ধাক্কা খেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের একাংশ বুদ্ধদেবের কিছু পলিশিগত ভুল দেখলেও, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর সিপিএমের অন্দরে দলিল পেশ করে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, শিল্পায়নের পথে এগোনোর জন্য তাঁর সরকারের নীতি ছিল সঠিক। শিল্পের জন্য জমি নেওয়াও ছিল সময়ের দাবি। তাঁর বক্তব্য ছিল, এই অনিবার্য প্রক্রিয়ার মাঝে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ‘ব্যতিক্রম’। দুই ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল। ব্যতিক্রম থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি। ব্যতিক্রমের জন্য শিল্পায়নের পথ থেকে সরা যায় না বলেই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু কোথায় কী? বুদ্ধদেব সরকারের পতনের পর থেকে একে একে বিভিন্ন শিল্প তৈরির গতি স্তব্ধ হতে থাকে। যত সময় গড়িয়েছে তত আক্ষেপ বেড়েছে। আর সেই আক্ষেপ কুরে কুরে খেয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে।
সিপিএমের জনসভা হোক বা সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার। বিভিন্ন জায়গায় রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হচ্ছে বলে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। এটা ঠিক, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর শিল্পায়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে একসময় সায় দেয়নি রাজ্যের মানুষ। জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মমতা নিজের রাজনৈতিক জমি তৈরি করছিলেন দুর্বার বেগে। নিজের মধ্যে পরিবর্তন এবং দলের ভিতরে পরিবর্তন আনতে চেয়ে খানিকটা একলাও হয়ে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব।

কিন্তু, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময় সেই উদ্বেগ ধরা পড়েছে তাঁর কথায়। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একবার বুদ্ধদেব বলেছিলেন, “এই রাজ্যের ছেলে-মেয়েরা কোথায় যাবে? ইনফোসিস, উইপ্রো এল না। এর মানেটা কী? আমার তো দুঃশ্চিতা হচ্ছে পাঁচ বছর পর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কলকারখানা নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তাঘাট নেই। সারা দেশ তো আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসবে।”

আজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নেই। কিন্তু বাংলায় শিল্পের ভবিষ্যৎ কি সত্যিই অন্ধকার হয়ে গেল? শিল্পায়নের স্বপ্ন, জমি অধিগ্রহণ, বিতর্ক, স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট দমবন্ধ করা চাপা কান্না হয়েই থেকে গেল না তো বুদ্ধদেবের বুকের ভেতর?