শ্যামলেশ ঘোষ: না, মানুষের তৈরি কোনও সীমারেখা পাখি, নদী বা বাতাসের প্রবাহ রুখতে পারেনি কখনও। যেমন ‘দোস্তি’ও কখনও আটকে রাখা যায়নি কোনও সীমানার অর্গলে। আর সেই বন্ধুত্ব যদি হয় পাকিস্তান আর তার ‘আজন্ম-শত্রু’ ভারতের বাসিন্দা দু’টি মানুষের? তখন দুই যুযুধান প্রতিবেশীর মাঝে সখ্যতার সেতু হয়ে ওঠেন তাঁরা। বিশেষ করে সম্প্রতি ভারতের সেনা-বহরে সন্ত্রাসী-হামলায় পঞ্চাশজনের কাছাকাছি জওয়ান-হত্যার ঘটনায় দু’দেশের মধ্যেকার উত্তেজনার আবহে বন্ধুত্বের কথা ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
আজ এমনই এক যুগলের বন্ধুদিন, মিত্রতার বৃত্তান্ত শোনাব আপনাদের। যদিও তাঁদের বন্ধুত্বের অনুভব চিঠির পাতায় রয়ে গিয়েছে চিরদিন। কেন না পত্রমিতালি পাতিয়েছিলেন তাঁরা। সুদীর্ঘ ৩৫ বছরে সে বন্ধুতায় ছেদ পড়েনি। তবে প্রায় ২৫ বছর আগে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন দু’জনে। তাই ‘হারিয়ে যাওয়া’ পত্রমিতাকে খুঁজে পেতে চান জনৈক পাক নাগরিক। ৮০ বছরের সিদ্দিক ফারুকের দাবি, দীপা নাম্নী কলকাতার জনৈক মহিলার সঙ্গে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিনদশক পত্রমিতালি সম্পর্ক ছিল। এবং সেই পেন-ফ্রেন্ডকেই লিখেছিলেন তাঁর জীবনের দীর্ঘতম চিঠিটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি ইংরেজি দৈনিককে অশীতিপর ফারুক জানিয়েছেন, “রীতিমাফিক পত্রমিতার সঙ্গে কোনও দিন সাক্ষাৎ হয়নি। জীবনের শেষলগ্নে এসে মনে হয়, একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বড় ভাল লাগত।”
পুরো নাম মোহাম্মদ সিদ্দিক ফারুক। ফারুক সাহেব একজন ব্যবসায়ী এবং স্ট্যাম্প, পাণ্ডুলিপি ও মানচিত্রের বিশিষ্ট সংগ্রাহক। ব্যবসার কাজে তাঁকে নিত্য দুবাই-করাচি যাতায়াত করতে হয়। সিদ্দিক ফারুকের বক্তব্য, “আমি আমার পত্রমিতাকে ১২৪০ পৃষ্ঠার হাতেলেখা একটা চিঠি দিয়েছিলাম। ১৯৮৮-তে করাচি থেকে রেজিস্টার্ড পোস্টে সেই চিঠি কলকাতায় পাঠাই। চিঠিটি লিখতে আমার দু’মাস সময় লেগেছিল। তার পর ডাকে দিই। সম্ভবত ১৯৬০-এ আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমরা পরস্পরকে অন্তত একশোখানা চিঠি দিয়েছি। যদিও ১৯৯৫ থেকে আমাদের যোগাযোগ হারিয়ে যায়।”
কীভাবে দাবি করছেন, আপনার চিঠিটিই বিশ্বে দীর্ঘতম? তবে তো এটা রেকর্ড! রসিক ফারুক সাহেবের দ্রুত জবাব, “সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দেখলে আমার দীর্ঘতম চিঠির কাছে বিশ্বরেকর্ডও তুচ্ছ। অবশ্য আমি রেকর্ডের জন্য সেই চিঠি লিখিনি বা কোথাও দাখিল করিনি। কোনও স্বীকৃতিও জরুরি নয়। এটা আমি যে লিখতে পেরেছি, তাতেই মহাখুশি।” চিঠির বিষয়বস্তু কী ছিল? “জীবন এবং সময়। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি অনুভব করি, তাতে আমার নিজের সম্পর্কে তেমন কিছু বলাই হয়নি।”
০০/০, ট্যাংরা রােড, কলকাতা ১৫-র (পুরো ঠিকানাটি উহ্য থাক) বাসিন্দা পত্রসখা সেই চিঠি পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। “তাঁর আনন্দের সীমা ছিল না। তিনি কখনও কল্পনাই করতে পারেননি যে, কেউ কোনওদিন এত দীর্ঘ একটা চিঠি লিখতে পারেন।” কীভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল সুদূর করাচি আর কলকাতার দুই সদ্যযুবার? সেই বন্ধুতার দিন মনে পড়তেই চঞ্চল হয়ে ওঠেন প্রবীণ। খানিক ভেবে বলেন, “স্ট্যাম্প সংগ্রহের নেশা ছিল আমার। সেই কথা জানিয়ে, আমার নাম দিয়ে কলকাতার একটি সংবাদপত্রের পত্রমিতালি কলামে বিজ্ঞাপন দিই। ভদ্রমহিলা সেই বিজ্ঞাপন দেখেই আমাকে চিঠি লেখেন। তখন তার বয়স ১৯, আমার ২০। তাঁর প্রথম চিঠির প্রথম লাইন আজও স্পষ্ট মনে আছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘দি ব্রাইটনেস অব দিস ডে অ্যাফেক্টেড মি অ্যান্ড আই রাইট দিস ডে।’ তিনি একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে এবং একটি লাইব্রেরিতে কাজ করতেন।”
ফারুক সাহেবের পরিবার আরব মুলুকে দুবাইয়ের বাস্তাকিয়ার পুরনো অধিবাসী। তাঁর পিতামহ আবদুল রহমান ফারুক সেখানকার দার আল নাথা ও ফারুক মসজিদের নকশা রচনা করেছিলেন ১৯২৫-এ। প্রিন্স চার্লস একবার দুবাই পরিদর্শনে গিয়ে এই দুইয়ের স্থাপত্যশৈলিতে মুগ্ধ হয়ে যান। পরে প্রশাসন দার আল নাথার মত সমৃদ্ধ স্থাপত্য সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়। ফারুক সাহেবের সংগ্রহে রয়েছে অমূল্য সব ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ। ১৮৭৯-এ শারজার শাসককে সম্বােধন করা স্ট্যাম্পড লিফলেটের মত বহু সামগ্রী। রয়েছে বিভিন্ন দেশের স্ট্যাম্প, পাণ্ডুলিপি ও মানচিত্রের বিশাল সংগ্রহ।
প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় বর্তমানে চিঠি লেখা এবং পত্রমিতালি একটি ক্ষয়িষ্ণু চর্চাই বটে। ফারুক বলেন, ‘পত্রমিতালি বানানাে একটি দারুণ হবি বা শখ। এটি একটি খুব ইতিবাচক এবং শিক্ষামূলক অনুশীলন। চিঠি মানুষের অনুভূতি বিনিময়ের এমন এক মাধ্যম, যেটা অন্য মাধ্যমে থাকে না। চিঠি লেখার বিশেষত্ব এই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজকের দিনে মানুষ চিঠি লিখতে ভুলে গিয়েছেন। অনেক বছর পরে পত্রমিতার সঙ্গে দেখা হওয়ার কাহিনি গল্পে পড়েছি। কিন্তু আমার পত্রমিতার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। আমি সবসময় ভাবতাম কোনও দিন হয়তাে আমাদের দেখা হবে। দীপা, আপনি কোথায়?’
ফারুক সাহেবের কথা ধরলে তাঁর পত্রমিতা দীপাদেবীর বয়স এখন ৭৯। সেই পত্রমিতা, যাঁকে
পাঠিয়েছিলেন ১২৪০ পৃষ্ঠার হাতেলেখা চিঠি। যা প্রকাশ্যে এলে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম চিঠির মর্যাদা পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মহিলা বন্ধুদের দুটি দলকে তালিকাভুক্ত করেছে, যে মহিলারা তাঁদের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ৭৭ বছর ধরে একে অপরকে চিঠি লিখেছেন। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডের কামব্রিয়ায় আটটি স্কুলের পড়ুয়ারা ন্যাশনাল স্টেশনারি সপ্তাহ ২০১৫ উপলক্ষ্যে ২১০ মিটার দীর্ঘ চিঠি লেখে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম চিঠি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ফারুক সাহেবের চিঠি প্রকাশ্যে আসবে কি? দীপাদেবী, আপনি শুনছেন?