কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পাঞ্জাবের পর এবার বিহার বিধানসভাতে পাস হলো জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি (এনপিআর) বিরোধি প্রস্তাব। এই প্রথম ভারতের বৈশিষ্ট্য – সমানাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
তাই দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে একের পর এক রাজ্য। গতবছরই ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য ওই সাধারণ মানুষদের ভয়াবহ পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই আইনের যথার্থতা সত্যিই কতটা গ্রহণযোগ্য।
লক্ষ্যনীয়ভাবে দেশজুড়ে বিরোধিতা সত্ত্বেও, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করার অবস্থানে অনড় দেশের শাসক দলের প্রধান সহ তাঁর দোসরেরা। এপর্যন্ত এনিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য কোন সদুত্তর তো দিতেই পারেননি, বরং জটিলতা কাটাতে গিয়ে দিনের পর দিন বাড়িয়ে চলেছেন বিভ্রান্তি। আরও গুরুতর বিষয় হল, এইমূহুর্তে নাগরিকত্ব আইনের বিষয়টি থেকে আমজনতার নজর ফেরাতে অত্যন্ত সুকৌশলে আদপে ওই আইনকেই কার্যকর করার নয়া পন্থা খুঁজে পেয়েছেন শাসক নেতৃত্ব। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী তৈরির প্রস্তুতি পর্ব অর্থাৎ এনপিআর। বিরোধীদের দাবি নস্যাৎ করে এই নতুন পরিকল্পনায় সাফল্য পেতে ঘরে ঘরে গিয়ে, পাড়ায় পাড়ায় চায়ের আসর বসিয়ে মগজধোলাইয়ের কাজও শুরু করে দিয়েছেন পদ্মশিবিরের নেতানেত্রীরা।
তবে বিরোধি সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগও থেমে নেই। এনসিআর-এর বিরোধিতায় যেমন 'কাগজ আমরা দেখাবো না' প্রতিবাদ জনপথ ছাড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও সাড়া ফেলেছে। তেমনই এনপিআর মে আসলে এনসিআর-এর প্রথম ধাপ তারই ব্যাখ্যা করতে তৈরি হয়েছে নতুন এক ভিডিও। এমনিতেই এবিষয়ে বিরোধি দল থেকে শুরু করে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলেও সহমত পোষণ করা হয়েছে।
ভিডিওটিতে বোঝানো হয়েছে যে সরকারের কৌশুলিরা মানুষকে বোকা বানাতে সরাসরি এনসিআর প্রয়োগ না করে কিভাবে মোট পাঁচটি পর্যায়ে আপনার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হতে পারে।
প্রথম পর্যায় এনপিআর: এই পর্বটি নাগরিকদের বহু পরিচিত বলা যায়। কারণ আগেও অর্থাৎ ২০১০-এ বা তারও আগে দেশের জনগণনার সময় ছোটো ছোটো কিছু প্রশ্ন নিয়ে সাধারণ সরকারি কর্মচারীদের পাঠানো হয়েছিল মানুষের বাড়িতে বাড়িতে। এনপিআর তো সেটাই। কিন্তু মোদি সরকারের এই জনগণনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র। কারণ এই প্রশ্নের মধ্যে এমন কিছু প্রশ্ন জুড়ে দেওয়া হয়েছে যা নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, বাবা মায়ের জন্মস্থান(জীবিত হোন বা মৃত), তাঁদের বয়স, আপনার আঁধার কার্ড নম্বর(যদি না হয়ে থাকে)। এমন আরও বহু প্রশ্নের উত্তর যেগুলির সাধ্যমত একটা উত্তর দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ। আর তারপরেই আসবে দ্বিতীয় পর্যায়।
দ্বিতীয় পর্যায় 'ডি' অর্থাৎ ডাউটফুল বা সন্দেহজনক: সন্দেহ কি নিয়ে? অবশ্যই আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে। কারণ ওই যে সহজ, সাধারণ প্রশ্নগুলির উত্তর আপনি নিশ্চিন্তে দিয়েছিলেন সেই উত্তরগুলির পোস্টমর্টেম করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে আপনি দেশের বৈধ নাগরিক কিনা? হলে চিন্তা নেই। আর না হলেই আপনার নামের সঙ্গে 'ডি' জুড়ে দেওয়া হবে। এবার আপনার অপেক্ষা করছে তৃতীয় এবং প্রধান পর্যায় 'এনআরসি'।
তৃতীয় পর্যায় এনআরসি: এই পর্যাযে যাদের নামের সঙ্গে 'ডি' জুড়ে দেওয়া হবে, হতে পারে পরিবারের সব সদস্যের নামের সঙ্গে এটা থাকবে না। কিন্তু তার নামের সঙ্গে 'ডি' জুড়ে যাবে তাদের নিজেদেরই দায়িত্ব নিয়ে প্রমাণ করতে হবে রে তিনি এদেশের বৈধ নাগরিক। তবে সেটা কিভাবে সম্ভব হবে তা কিন্তু কেন্দ্র সরকার জানায়নি। কারণ সরকারিভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে আঁধার কার্ড, ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড কোনোটাই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। অসমের এনআরসি প্রক্রিয়া এভাবেই চলছে। সেখানে নাগরিকত্বর প্রমাণ হিসেবে চাওয়া হয়েছে জন্মের সংশাপত্র, বহুদিন আগেকার ভোটার কার্ড বা সম্পত্তি প্রমাণপত্র, এইধরণের নথি। মা বহু সাধারণ মানুষ, বিশেষত বর্ষীয়ানদের কাছে না থাকাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সম্মুখীন হতে হবে চতুর্থ পর্যায়ের অর্থাৎ বিদেশি ট্রাইব্যুনালের বা বিদেশিদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি আদালতের। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করা যাবে। মা হবে অত্যধিক খরচ এবং সময় সাপেক্ষ, হয়রানির চূড়ান্ত পর্যায়।
চতুর্থ পর্যায়ে বিদেশি ট্রাইব্যুনাল: এই বিদেশি ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি বিদেশি। এক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কোন সুযোগই নেই। কারণ এই সম্প্রদায়কে বিদেশি বলেই গণ্য করা হবে যদি তাদের পূর্বপুরুষ ৫০০ বা তারও বেশি সময় ধরে এদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন তাও তারা বিদেশি। সুতরাং তাদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) অনুসারে এদেশে থাকার কোন অধিকারই নেই। কিন্তু যদি আপনি মুসলমান সম্প্রদায়ের না হয়ে থাকেন তাহলেও সমস্যা গুরুতর। কারণ এক্ষেত্রে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের নাগরিক। কারণ শুধুমাত্র এই দেশগুলি থেকে আসা শরণার্থীদেরকেই ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে(সিএএ) উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এমনকি দেশের অন্যান্য রাজ্যের মানুষও বিভিন্ন কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছেন বহুবছর ধরে। তারা কিভাবে প্রমাণ করবেন যে তারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের নাগরিক? হলে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে বিদেশি বলে প্রমাণ করতে না পারলেও আপনাকে বিদেশি বলেই ঘোষণা করা হবে। আর এরপর আপনার সামনে পঞ্চম এবং শেষ পর্যায় অর্থাৎ ডিটেনশন সেন্টার বা শরণার্থী শিবির।
পঞ্চম পর্যায় ডিটেনশন সেন্টার বা শরণার্থী শিবির: এই শরনার্থী শিবির হল বিদেশিদের জন্য ভারত সরকারের তৈরি বিশেষ জেল। যেখানে দেশের স্বাভাবিক নাগরিকের প্রাপ্য সমস্ত সরকারি সুবিধা কেড়ে নিয়ে বিদেশি তকমা সেঁটে শরনার্থী শিবিরে জায়গা দেওয়া হবে আপনাকে। এই শরনার্থীদের জন্য আলাদা নিয়মবিধিও তৈরি করে ফেলেছে সরকার। দেশের শাসক নেতৃত্ব স্বীকার না করলেও বিভিন্ন সূত্রে খবর এমনকি গোপন ছবিও প্রকাশ্যে এসেছে এই শরণার্থী শিবিরের। অসমে এই শরণার্থী শিবির ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেছে। কর্নাটকে কাজ চলছে। দেশের আরো দশটি রাজ্যে এই ধরণের ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির প্রস্তুতি চলছে।
সুতরাং, দেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার মোদি সরকারের এই সুকৌশলী পন্থা শুধু যে সংবিধানবিরোধী তাই নয় আগামী দিনে দেশের সাধারন মানুষের চরম দুর্দশার কারণ হয়ে উঠতে চলেছে। তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর হওয়ার আগে প্রথম পর্যায় অর্থাৎ এনপিআর থেকেই রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। সেক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক এনপিআর কার্যক্রমের সঙ্গে নিযুক্ত কর্মীরা বাড়িতে এলে ভদ্রভাবে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। 'নো এনপিআর, 'নো এনআরসি' 'নো সিএএ'।