‘পাক এজেন্ট’ কলঙ্ক মুছতে ১০২ বছরেও CV লিখছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী!

‘পাক এজেন্ট’ কলঙ্ক মুছতে ১০২ বছরেও CV লিখছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী!

বেঙ্গালুরু: ‘‘তিনি আদতে স্বাধীনতা সংগ্রামী নন৷ পাকিস্তানের এজেন্ট৷’’ বিজেপি নেতার আনা এই অভিযোগ নস্যাৎ করতেই ১০২ বছর বয়সে বায়োডাটা তৈরি করছেন সমাজ সংস্কারক এইচএস দোরেস্বামী৷

দক্ষিণ বেঙ্গালুরর এক তলা বাড়িতে বসে একগুচ্ছ কাগজ উল্টাতে উল্টাতেই দোরেস্বামী বলেন, “আমি আমার বায়ো ডেটা লিখছি৷ পড়ে দেখুন এতে কোথায় দেশদ্রোহী কিছু রয়েছে কি না৷’’ এই ঘরে বসেই দোরেস্বামী শোনালেন তাঁর জীবন কাহিনী৷

১৯১৮ সালে বেঙ্গালুরুতে জন্ম তাঁর৷ বললেন ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনে থেকে সাম্প্রতিক সময়ের কথাও৷ যার আন্দোলনের জেরে ঝড় উঠেছে বেঙ্গালুরু জুড়ে। কয়েক দশক ধরে কর্নাটকের সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দোরেস্বামী এখন রাজনৈতিক ঝড়ের কবলে। সৌজন্য বিজাপুরের বিজেপি বিধায়ক বসনগৌড়া পাতিল ইয়াতনাল৷ দোরেস্বামী ‘ভুঁয়া স্বাধীনতা সংগ্রামী’ ও ‘পাকিস্তানের চর’ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যুক্ত থাকার প্রমাণও দাবি করেন এই বিজেপি নেতা৷  কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি সহ বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারা পাশে দাঁড়ান বসনগৌড়ার৷

এর পরই গত মঙ্গলবার বিজেপি’কে চ্যালেঞ্চ করে ১৯৭১ সালের এক নথি প্রকাশ করে কংগ্রেস৷ বেঙ্গালুরু কেন্দ্রীয় জেলের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ড্যান্টের স্বাক্ষরিত ওই নথিতে সাফ বলা হয়েছে, “২৫ বছরের অবিবাহিত যুবক দোরেস্বামী ১৯৪২ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৩ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই জেলে বন্দি ছিলেন।” দোরেস্বামীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ এনেছেন বিজেপি নেতারা৷ তাঁধের দাবি, গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশদ্রোহী স্লোগান দিয়ে গ্রেফতার হওয়া ১৯ বছরের তরুণী অমূল্যা লিওনা নোরোনহার সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। কোপ্পায় অমূল্যার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া একটি ছবির উফর ভিত্তি করেই দোরেস্বামীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনে গেরুয়া শিবির৷

এই ঘটনার পর ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বলেন, “উনি আমাদের রাজ্যের বিবেক। দোরেস্বামীর বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে আমি হতবাক৷ এটি আমাদের রাজ্যের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়৷’’  উনি একজন ভদ্র ও সৎ মানুষ৷ একাধিক সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তিনি৷ আন্দোলন করেছেন কৃষক ও ভূমিহীনদের জন্য৷ তিনি কংগ্রেস সরকারের ভূমি নীতির বিরুদ্ধেও সসব হয়েছিলন৷ গুহ আরও বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পায় নীরবতায়৷ যিনি একদিন কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর শপথ করেছিলেন৷’’

বিজেপি নেতার অভিযোগে বিস্মিত দোরেস্বামী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি গত ৬০ বছর ধরে প্রকাশ্য জীবন কাটাচ্ছি। মতাদর্শগত ফারাক থাকলেও বিজেপি ও আরএসএসেও আমার বন্ধুরা রয়েছেন। আমি আশা করিনি পুরো বিজেপি এমনভাবে আমাকে আক্রমণ করবে৷’’

তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেছেন এ কথা স্বীকার করেই বলেন, “আমি সব সরকারকেই সমালোচনা করি। একজন নাগরিক হিসাবে এটা আমার অধিকার। জরুরি অবস্থার সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম৷ লিখেছিলাম, আপনি গণতন্ত্রের শাসক, কিন্তু ব্যবহার করছেন একনায়কের মতো৷ এরকম চলতে থাকলে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতে আপনি একনায়ক।” এরপরেই দোরেস্বামীকে গ্রেফতার করা হয়৷ চার মাস জেলে থাকার পর ছাড়া পান তিনি৷ এক ম্যাজিস্ট্রেট কেসটি খারিজ করেন৷ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করার সমস্ত অধিকার রয়েছে ওঁনার৷

বেঙ্গালুরুর স্কুলে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের প্রাক্তন শিক্ষক দোরেস্বামী ১৯৪২ সালের জুন মাসে গান্ধীজির আহ্বানে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন৷ তিনি বলেন, “আমরা সরকারি অফিসের কাছের পোস্ট বক্সগুলোতে ছোট ছোট টাইম বোম রাখতাম। সেগুলো মানুষ খুন করবার জন্য ছিল না। ওগুলোতে নথি পুড়ে যেত, সরকারের যোগাযোগে ক্ষতি হত৷’’ এ কাজের জন্যও গ্রেফতার হতে হয়েছিল তাঁকে৷ ১৯৪৩ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুরোপুরিভাবে  স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি৷

পরের দশকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে যোগ দেবেন দোরেস্বামী। তার মধ্যে রয়েছে কাইগা পারমাণবিক প্ল্যান্ট বসানো থেকে উত্তর কর্নাটকে ভূমিহীন কৃষকদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনও। ২০১৪ সালে দোরেস্বামী এবং নিহত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ একটি নাগরিক সমাজ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন৷  যাদের মূল কাজ ছিল অস্ত্র ছেড়ে নকশালপন্থীদের মূলস্রোতে ফিরতে সাহায্য করা। “আমরা চাই নকশালরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্ত হন। আর এরা আমাকে বলছে নকশাল।” আক্ষেপের সুর দোরেস্বামীর গলায়৷

পুরনো স্মৃতি হাতড়ে দোরেস্বামী বলেন, আরএসএসের কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী না থাকায় তারা কতটা দুর্বল শক্তি ছিল৷ তিনি মনে করেন, সরকারের ব্যর্থতাই বিজেপির উত্থানের কারণ। “গান্ধী চেয়েছিলেন দারিদ্রদূরীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। কিন্তু রাজনীতিবিদরা এটি ছাড়া বাকি সবকিছু করেছেন৷ চাঁদে গিয়েছেন, টাকাপয়সা নয়ছয় করেছেন।” তিন মাস আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়ের বাড়ির কাছে একটা বাড়িতে চলে এসেছেন ১০২ বছরের দোরেস্বামী৷ তাঁর অভিযোগ, ‘‘ যুব সম্প্রদায়ের মনে মুসলিম বিদ্বেষ ভার ভরে দিচ্ছে।”

দোরেস্বামী অবশ্য এসব নিয়ে চিন্তিত নন৷ তিনি বলেন, “আমার বন্ধুরা বলেছে ওরা আমার কণ্ঠ রোধ চায়। কিন্তু নিয়ম কানুন রয়েছে, আমাদের রক্ষা করার জন্য সংবিধান রয়েছে। মানুষ রয়েছেন। তাঁরা আমাকে সম্পূর্ণ জানেন। আমার জীবন আয়নার মত। নিশ্চিতভাবেই মানুষ আমার পাশে দাঁড়াবেন… গরিব মানুষের খাবার অধিকার আছে, রোজগারের অধিকার আছে, শিক্ষার অধিকার আছে৷ সে কারণেই আমি আজও লড়ে যাচ্ছি৷’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 5 =