নির্ভয়াকাণ্ডে অন্যতম কাণ্ডারী ছায়া শর্মা, তাঁর নেতৃত্বেই মিলেছে সাফল্য

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্ভয়া ধর্ষণের  ১৮ ঘন্টার মধ্যেই বাসটিকে সনাক্ত করে ফেলে তৎকালীন দিল্লি পুলিশের ডিসিপি ছায়া শর্মার নেতৃত্বে ১৪ জনের দল। ড্রাইভারকে যাচাই করতে দু-তিন ঘন্টা সময় লাগে। অপরাধীদের কয়েকজন ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ধরা পড়েছিল।

নয়াদিল্লি: দীর্ঘ সাত বছর পর ২০ মার্চ,২০২০ নির্ভয়া কান্ডের  অপরাধী মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় কুমার সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল।  এই চার অপরাধী সহ আরও দুজন যারা নৃশংসতা ও পাশবিকতার নজির গড়েছিল, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে নির্ভয়াকে ন্যায্য বিচার পাইয়ে দিতে যার নাম প্রথমেই উঠে আসে তিনি হলেন তৎকালীন দিল্লি পুলিশের ডিসিপি ছায়া শর্মা। বিচারবিশ্বাসযোগ্যতা এবং অখণ্ডতা এই দুটি বিষয়ের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস আইপিএস ছায়া শর্মার। ছায়া, যিনি বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে উপ-মহাপরিদর্শক (তদন্ত) পদে রয়েছেন। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্ভয়ার গণধর্ষণ ও হত্যা কান্ডের তদন্ত তাঁর নেতৃত্বেই হয়েছিল। তখন দিল্লি পুলিশের ডিসিপি (দক্ষিণ জেলা) পদে ছিলেন। ঘটনার দিন থেকে তিনিই ছিলেন তদন্তের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক। নির্ভয়াকান্ডে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত দোষীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অনবদ্য ও দৃঢ় ভূমিকা রাতারাতি তাকে খবরের শিরোনাম এনেছিল।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ছায়া শর্মা ১৯৯৯-এ দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টায় ইউপিএসসি পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। ২০১২ সালে, যখন নির্ভয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল, তখন তিনি দিল্লি দক্ষিণের পুলিশ কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই ঘটনার ভয়াবহতা দেশের বিরল থেকে বিরলতম ঘটনাগুলির মধ্যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। অপরাধীদের পাশবিকতা কার্যত হতবাক করে দিয়েছিল গোটা দেশের মানুষকে। এমনকি বিদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলির মূল খবরের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল। তারপর অপরাধীদের সনাক্ত করার পরেও বিগত এই ৭বছর ধরে শুধুমাত্র আইনি জটিলতার কারণে তাদের সাজা বার বার পিছিয়ে যাওয়া, পাশাপাশি দেশে দিন দিন বেড়ে চলা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও মানুষের মনে নির্ভয়ার স্মৃতিকে আরও তাজা ও প্রাসঙ্গিক করে তুলছিল। 

গত বছর 'লজিকাল ইন্ডিয়া' ছায়া শর্মার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। এই প্রতিবেদন তারই অংশবিশেষ।

ঘটনার দিন রাত ২.১০ নাগাদ তৎকালীন দিল্লি পুলিশের ডিসিপি (দক্ষিণ জেলা) ছায়া শর্মার কাছে অপারেটর অনুপ সিংয়ের একটি ফোন আসে। তার অপারেটরদের বলাই ছিল যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পিসিআর কল নজরে এলে এবং তার গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে তেমন তাঁকে ফোন করে জানানো হয়। ফোন পেয়েই তিনি পৌঁছে যান

সাফদরজং হাসপাতালে, যেখানে আহত নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে ঘটনার অস্বাভাবিক প্রকৃতি এবং পরিনতি হিসেবে আঘাতের বিষয়টি জানতে পেরে রীতিমতো শিউড়ে ওঠেন, হতবাক হয়ে যান ছায়া। তাঁর কথায়, নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে যেভাবে নগ্ন অবস্থায় বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বাসের চাকায় পিষে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল চাচির কল্পনার থেকেও ঘৃণ্য এবং ভয়ঙ্কর। সেই নৃশংসতাই ছায়ার মনে অপরাধীদের ধরার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি অবাক হয়েছিলেন কিভাবে দিল্লির একটি আলো ঝলমলে রাস্তায় রাত সাড়ে নটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে একটি চলন্ত বাসে এমন  একটা ঘটনা ঘটতে পারে। সেই যাবৎ কর্মজীবনে ধর্ষণের যেকটি ঘটনা দেখেছিলেন তার ধরতে এটাই ছিল সবথেকে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। কিন্তু এটা এমনই ঘটনা ছিল যেখানে প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল পুলিশ। কারণ সূত্রগুলি একেবারেই অস্পষ্ট ছিল। 

কিন্তু ছায়া যখন নির্ভয়ার অসহায় বাবা-মার সঙ্গে দেখা করলেন তখনই স্থির করে নিয়েছিলেন যে দোষীদের খুঁজে বের করতেই হবে তাঁকে।  

ছায়ার কথায় “আমি শুধুমাত্র দলের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারিনি, কারণ আমার মনে হয়েছে আমি কোনো সামান্য সূত্রও হাতছাড়া করতে পারবনা। একজন মহিলা হিসাবে আমি আঘাতের প্রকৃতি বুঝতে পারছিলাম এবং অনুভব করেছিলাম যে নির্দোষ ওই বাচ্চা মেয়েটি কিভাবে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিল।” 

অপরাধীরা কারা ছিল, পুলিশের সেবিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না, তবে নিজের দলের ওপর প্রচন্ড আস্থা ছিল ছায়ার। কেবলমাত্র কোনো সাদা বাসের ভিতরেই যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার একটি অস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া গেছিল। কিন্তু দিল্লিতে ওই ধরণের সাদা বাস তো কম নয়, তাই নির্দিষ্ট বাসটিকে খোঁজা “খড়ের গাদায় সূঁচ” খোঁজার চেয়ে কম ছিল না বলে উল্লেখ করেন ছায়া।  তবে তার দল ঘটনার ১৮ ঘন্টার মধ্যেই বাসটিকে সনাক্ত করে ফেলে এবং ড্রাইভারকে যাচাই করতে দু-তিন ঘন্টা সময় লাগে। ছায়া বলেন দলে সমস্ত ধরণের আধিকারিক ছিলেন, তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ এবং আলাদা প্রচেষ্টাও ছিল। তবে তারা সবাই তাদের সেরাটা দিয়েছিল এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করা থেকে বিচার প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় সমস্ত সহায়তা তে এবং বিচারের জন্য  কাজ করে। ছায়ার নেতৃত্বে ১৪জনের দলে ছিলেন রাজিন্দর, কে.পি. মালিক, বেদ, গগন, নীরজ, নরেশ, প্রতিভা এবং অনিলের মতো কয়েকজন।

দৃঢ়- সংকল্প নিয়ে দলের নেতৃত্বে থেকে পাঁচ দিনেই সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের করেন। বাস্তবে, এদের কয়েকজন ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ধরা পড়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে রাম সিং, তাঁর ভাই মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত, অক্ষয় ঠাকুর এবং এক কিশোর রয়েছে। রাম সিংহকে পরে তিহার কারাগারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে, তিন বছরের মেয়াদ শেষ করে ২০১৬ সালে কিশোরকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং বাকি চারজন বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডে রয়েছেন। এই ভয়াবহ অপরাধ করেছে যারা তাদের সাথে তিনি কীভাবে আচরণ করছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “অনেক সময় তারা অযৌক্তিক কথা বলে এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে বলে আমরা হতাশ বোধ করি। তবে, বছরের পর বছর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে আবেগ থেকে দূরে থাকতে, তা রাগ হোক বা অন্যকিছু । 

তিনি আরও বলেছেন, “ এই ঘটনার পরে যে সমস্ত প্রতিবাদ হয়েছিল এবং বসন্ত বিহার থানা ও সাফদারজং হাসপাতালের আগেও দক্ষিণ জেলার বিক্ষোভকারী ও মিডিয়া কর্মীদের সামনেও দারুণ সংযমী ছিল দিল্লি পুলিশ। ধৈর্য সহকারে পুরো প্রক্রিয়াটি সামলেছেন তাঁরা।

ভারতীয়দের গর্বিত করে ছায়া শর্মা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের জন্য ম্যাককেইন ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাপূর্ণ সাহস ও নেতৃত্ব পুরষ্কার ম্যাকেইন-এ জিতে নিয়েছিলেন ২০১৯-এ। প্রতি বছর, এই পুরষ্কারটি এমন কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সম্মান জানাতে দেওয়া হয় যারা মৌলিক মূল্যবোধের জন্য নিজের কাজে অবিচল থাকে এবং বিশ্বকে তাদের ব্যতিক্রমী সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত করে। মহিলা পুলিশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য এশিয়া সোসাইটি গেম চেঞ্জার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সেই বছরই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − two =