বাড়ি বিক্রি করে জুগিয়েছেন নাতনির পড়ার খরচ, অটোয়-বন্দি শেষ জীবন!

বাড়ি বিক্রি করে জুগিয়েছেন নাতনির পড়ার খরচ, অটোয়-বন্দি শেষ জীবন!

 

মুম্বই: এও যেন এক ‘বাবা কা ধাবা’র গল্প৷ গত বছরের করোনা বিপর্যস্ত সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল দক্ষিণ দিল্লির মালব্যনগরের কান্তা প্রসাদের চোখের জল৷ আর এবছরের গোড়ার দিকে নেটাগরিকদের মন ভেজাল মুম্বইয়ের অটোচালক দেশরাজের হৃদয়বিদারক কাহিনি৷ কান্তা প্রসাদের মতো তাঁর জন্যও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢল নেমেছে সহানুভূতির, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করেছে আর্থিক সাহায্যের হাত৷ দেশরাজের জীবন সংগ্রামের এই গাথা শেষ পর্যন্ত কোনও মধুরতম পরিসমাপ্তির দিকে বাঁক নেয় কি না, সেটাই এখন দেখার৷

মুম্বইয়ের খার এলাকার সামান্য অটোরিকশা চালক৷ ফলে জীবনযুদ্ধের পথটা এমনিতেই মসৃণ ছিল না৷ তার ওপর অকালে দুই ছেলেকে হারানোর পর, দুই পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিদের এগিয়ে নিয়ে চলার তাগিদই শক্তি জুগিয়েছিল দেশরাজকে৷ ‘হিউম্যানস অফ বম্বে’র সঙ্গে আলাপচারিতায় দেশরাজ বলেছেন, ‘ছ’বছর আগে আমার বড় ছেলে অন্য দিনের মতোই কাজে যায়৷ কিন্তু আর ফেরেনি৷’ এক সপ্তাহ পর উদ্ধার হয় ছেলের নিথর দেহ৷ ৪০ বছরের ছেলের জন্য শোক করার সময়টুকুও পাননি হতভাগ্য বৃদ্ধ৷ তাঁর কথায়, ‘ছেলের সঙ্গে আমার একটা অংশও মরে গেল, কিন্তু দায়িত্বের বোঝায় আমি কাঁদার সময়টাও পাইনি৷ পরের দিনই অটো নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি৷’ এখানেই শেষ নয় দুর্ভাগ্যের৷ দু’বছর পর আত্মঘাতী হয় ছোট ছেলে৷ শোকাতুর দেশরাজ বলেন, ‘পুত্রবধূ আর তাঁদের চার সন্তানের দায়িত্ব তার পরও আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷’

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নাতনি দেশরাজের কাছে জানতে চেয়েছিল, স্কুল ছেড়ে দেব কি না৷ বৃদ্ধ আশ্বাস দিয়েছিলেন, সে যত দূর চায় পড়তে পারে৷ পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ভোর ছ’টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত অটো চালাতেন দেশরাজ৷ মাসে দশ হাজার টাকা আয়ের ছ’হাজার টাকা খরচ হত নাতি-নাতনিদের পড়াশোনায়৷ বাকিটায় পেট চলত আরও সাত জনের৷ বেশিরভাগ দিনই পেটে পড়ত না কিছু৷ কিন্তু সব কষ্ট উবে গিয়েছিল যখন দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল নাতনি৷ আনন্দের চোটে সারাদিন যাত্রীদের থেকে নেননি কোনও পয়সা৷

নাতনি যখন বিএড পড়তে দিল্লি যেতে চেয়েছিল, তখন দেশরাজ জানতেন এই খরচ তিনি বহন করতে পারবেন না৷ কিন্তু নাতনির ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে যে কোনও মূল্যে৷ তাই বাড়ি বিক্রি করে জুগিয়েছিলেন পড়ার খরচ৷ বউ, দুই পুত্রবধূ আর অন্য নাতি-নাতনিদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে৷ আর নিজের দিন কাটত মুম্বইয়ের রাস্তায় অটো চালিয়েই৷ দেশরাজ বলে চলেন, ‘প্রায় একবছর হল সারাদিন যাত্রী পারাপারের পর খাওয়া-ঘুম সব অটোতেই৷ সত্যি বলতে কী, জীবনটা মন্দ লাগছে না৷’ যাঁর জীবনের রোজনামচা গড়াচ্ছে অটোর চাকাতেই, সেই গর্বিত পিতামহর সব দুঃখ লাঘব হয়ে যায় যখন তিনি জানতে পারেন, তাঁর নাতনি ক্লাসে প্রথম হয়েছে৷ সেই যে হতে চলেছে পরিবারের প্রথম স্নাতক৷ যেদিন সেই দিনটা আসবে, সেদিনও তাঁর অটোয় বিনা পয়সায় ভ্রমণ যাত্রীদের৷

এই বয়সেও দেশরাজের অদম্য লড়াই মন ছুঁয়েছে নেটিজনদের৷ অনেকেই করতে চেয়েছেন অর্থ সাহায্য৷ ইতিমধ্যেই ২৭৬ জন দাতার হাত ধরে ভাঁড়ারে জমা পড়েছে ৫.৩ লাখ টাকা৷ দেশরাজের কাহিনি টুইটারে পোস্ট করেছেন কংগ্রেসের অর্চনা ডালমিয়া, রিটুইট করেছেন মিলিন্দ দেওরা৷ অটোচালকের ফোন নম্বর শেয়ার করে মুম্বইকরদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন ডালমিয়া৷ কান্তা প্রসাদের মতো দেশরাজেরও দিনবদল যেন সময়ের অপেক্ষা৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − nine =