তপন মল্লিক চৌধুরী : গেল শতকের তিনের দশকের একেবারে গোঁড়ার দিকে শীতকালে এদেশে বেড়াতে এলেন এক অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক। তাঁকে স্থানীয় এক ক্রিকেট দল একটি প্রীতি ম্যাচে খেলার নিমন্ত্রণ করল। অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক আনন্দের সঙ্গে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু খেলতে নেমে প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে গেলেন তিনি। স্বভাবতই তাকে আর কেউ মনে রাখলেন না। ধরেই নেওয়া হল ওই লোকটা ক্রিকেট খেলতে পারে না।
প্রায় ৪০ বছর পর অস্ত্রেলিয়ায় অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ-এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার খেলা। টনি গ্রেগ আর হিলটন অ্যাকারম্যান সেই ম্যাচ খেলতে এলেন অ্যাডিলেড। ঘটনাচক্রে বিমানবন্দরে তাদের রিসিভ করতে যিনি এলেন সেই তিনি সেই প্রথম বলে আউট অস্ট্রেলিয়ান। তখন তিনি বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। তবে ক্রিকেট নিয়ে সেদিন তিনি অনেক কথা বলছেন যা সাধারণ কথা নয়। তার কথা শুনে টনি বা অ্যাকারম্যানের কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কখনও ক্রিকেট খেলতেন? বৃদ্ধ সবিনয়ে জবাব দিলেন- তা খেলতাম এককালে। প্রশ্নকর্তা আবার প্রশ্ন করলেন- আপনার নাম? তিনি বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন- ডন ব্র্যাডম্যান!
১৯৪৮ সালের কথা। কাঠিয়াওয়ার নামে একটি জায়গার একটি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলছিল মহারাষ্ট্রের একটি দল। সেই খেলায় নিম্বলকর নামে এক ব্যাটসম্যান যখন ৪৪৩ রানে অপরাজিত তখন দুটি দল এবং আম্পায়ার মিলে সেই ম্যাচটি আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তারা মনে করেছিল স্যার ডনের রেকর্ড অতিক্রম করাটা ঠিক নয়।
প্রায় একই ধরণের ঘটনা ঘটে টেস্ট ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন তখন মার্ক টেলর। টেস্টে ৩৩৪ রানে তিনি যখন অপরাজিত, তখন তিনি মনে করলেন আর ব্যাট করবেন না। তাঁরও মনে হয়েছিল, ‘স্যার’কে অতিক্রম করাটা ঠিক নয়। উল্লেখ্য, প্রথমশ্রেণীর এবং টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডনের সর্বোচ্চ সংগ্রহ যথাক্রমে ৪৫২ এবং ৩৩৪।
১৯৬৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রোবেন দ্বীপে বন্দি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে ১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজং দেখা করতেএলে ম্যান্ডেলা ফ্রেজারকে প্রথম প্রশ্ন করেন, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান কি এখনও বেঁচে আছেন?
স্কুলে পড়াকালীন স্যার ডনের প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক। যদিও লেখাপড়ার চেয়ে ক্রিকেটে আগ্রহ বেশি থাকায় স্কুলও শেষ করেন নি। তবে ক্রিকেটার না হয়ে তিনি মিউজিশিয়ান হলেও মনে হয় ভাল কিছু করতে পারতেন। ১৯৩০ সালে ডন ‘ইজ আ রেইনবো ডে ফর মি’ নামে একটি গান কম্পোজ করে রেকর্ড করেছিলেন। এছাড়া পিয়ানোবাদক হিসেবেও ‘অ্যান ওল্ড ফ্যাশনড লকেট’ এবং ‘আওয়ার বাংলো অব ড্রিমস’ নামে তাঁর দু’টি গান আছে।
১৯৩৬-৩৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজের সময় অ্যাডিলেডে বসে ব্র্যাডম্যান বিল ওরিলি এবং নেভিল কার্ডাসের সঙ্গে একটি পুরো সন্ধে আলোচনা করলেন- কী করে ওয়ালি হ্যামন্ডকে বেঁধে রাখবেন। বাড়ি ফেরার সময়ে রাত তখন এগারোটা বাজে, ‘একটু কাজ আছে’ বলে গাড়ি থেকে নেমে নেমে গেলেন ব্র্যাডম্যান। ওই রাতে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে। পরদিন শোনা গেল ব্র্যাডম্যানের অসুস্থ শিশুটি হাসপাতালেই মারা গেছে। হয়ত সে কারণেই অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেঞ্জিস বলেছিলেন- স্যার ডন ব্র্যাডম্যান আমাদের যা দিয়ে গিয়েছেন তা ক্রিকেট খেলার চাইতেও অনেক বেশি।
সিডনির একটি চার্চে জেসি মারথা মেঞ্জিসের সঙ্গে ব্র্যাডম্যানের বিয়ে হওয়ার পর তাদের প্রথম সন্তান, কিন্তু জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে জনও জন্মের পর পোলিওতে আক্রান্ত হয়। মেয়ে শার্লিরও জন্মগতভাবেই মস্তিষ্কজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকে। নিজেই বলেছিলেন ৬৫ বছরের পারিবারিক জীবনটা উপভোগের সুযোগ সেভাবে পাননি তিনি। আর সন্তান …
সব ব্যাটসম্যানই শূন্য রানে আউট হন। তবে টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটি স্যার ডনের। ১৯৪৮-এ ওভালে শেষ টেস্টে নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার সময় ব্যাটিং গড় ১০০ করতে স্যার ডনের দরকার ছিল মাত্র ৪ রানের, কিন্তু এরিক হলিস নামের অখ্যাত এক লেগ স্পিনার তাকে হতাশ করে দিলেন। জীবনে একবার মাত্র হিট আউট হয়েছিলেন স্যার ডন, যা হয়েছিলেন লালা অমরনাথের বলে। ডন জীবনে একবার-ই স্টাম্পড হয়েছিলেন। আর সেই উইকেট ভেঙেছিলেন এক বাঙালি- প্রবীর মিত্র।