কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির বৈঠক মঞ্চ থেকে শিক্ষকদের বার্তা দিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ নজরুল মঞ্চে থেকে বদলি ইস্যুতে শিক্ষকদের কাঠগড়ায় তুলে শিক্ষামন্ত্রী৷ শিক্ষিকাদের ‘স্ত্রী-রোগ’ নিয়েও কটাক্ষ করেন তিনি৷ শিক্ষিকাদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে শিক্ষক মহলে৷
বৃহস্পতিবার নজরুল মঞ্চে শিক্ষিকাদের কাঠগড়ায় তুলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘মিউচুয়াল ট্রান্সফার আমি করে দেব৷ বলেছিলাম না, অসুস্থ হলে বদলি করা হবে৷ এখন দেখছি সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে৷ সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে৷ আর এত বেশি মহিলা শিক্ষিকা, তারা স্ত্রীরোগের ভুগছেন, আমি নিজে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। এটা কি হচ্ছে? জেনুইন কিছু থাকলে আমরা অবশ্যই দেখবো৷ আমি তো বলেছি জেলা শিক্ষিকাদের জেলায় রাখতে৷ আপনি যখন মহিলা ছিলেন, মানে যখন অবিবাহিত মহিলা, আপনি কল্যাণীতে কাজ করতেন৷ বিয়ে করে চলে গেলেন কাকদ্বীপে৷ এবার ট্রান্সফারের কারণ কী? বর আছে বেহালায়৷ সেই কারণে ট্র্যান্সফার লাগবে৷ কিন্তু কেউ এসে বলল না ওখানে ছাত্র-ছাত্রী বেশি আছে আমি ওখানে যেতে চাই৷’’
শিক্ষামন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী৷ বলেন,‘‘বদলির আবেদন প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষিকাদের সম্পর্কের যে মন্তব্য করেছেন, তা কোনভাবেই সমীচীন নয়৷ শিক্ষিকারা বৈবাহিক সূত্রে কোথায় আবদ্ধ হবেন তা নিয়ে কটাক্ষ করা শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে কোনভাবেই শোভনীয় নয়৷ তাঁর এই মন্তব্যের আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি৷’’
মুর্শিদাবাদের শিক্ষক নেতা তন্ময় ঘোষ বদলি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘‘এতদিন জানতাম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি ব্যর্থ৷ আজ আবার স্ত্রী-রোগ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে শিক্ষিকাদের চরম অপমান করেলেন৷ শিক্ষামন্ত্রী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ কবে থেকে হলেন? এই মন্তব্যে শিক্ষিকাদের সম্মানহানির হয়েছে৷ শিক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত৷’’
এদিন শিক্ষামন্ত্রী বদলি প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘‘আমার ডিপারমেন্টকে বলে দিয়েছি, মেয়েদেরকে যতটা পারো জেলার মধ্যে রাখো৷ শিক্ষিকাদের জেলার মধ্যে রাখতে যদি না পারো, পাশের জেলায় দাও৷ এটা তো আমরা নতুন নিয়োগে করেছি৷ আমরা ট্রান্সফার চালু করেছি৷ ৭০ হাজারের ওপর বদলি করা হয়েছে৷ মিউচুয়াল ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করুন আমরা দেখছি৷ কিছু করা যায় কিনা, দেখছি৷ কিন্তু এটা বলে রাখছি, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কম, সেখানে বদলি করা হবে না৷ কাউকে মুড়ি খাওয়ার জন্য ট্রান্সফার করা হবে না৷ আমরা চাই যেখানে শিক্ষক কম আছে অথচ ছাত্র-ছাত্রী বেশি, সেখানে আমরা পাঠাবো৷ আমরা চাই শিক্ষক তাঁর সম্মান, আত্মমর্যাদা নিয়ে কাজ করুক৷ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেবেন তাঁরা৷ পড়াবেন৷’’
এদিন শিক্ষকদের গ্রেড পে বৃদ্ধির ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের বেতন কাঠামো পরিবর্তন করছি৷ আপনাদের গ্রেড-পে ৩২০০টাকা সুপারিশ করেছিলাম৷ কিন্তু, ৩৬০০টাকা গ্রেড পে করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা হচ্ছে৷ কবে এটা চালু হবে তা আমরা জানিয়ে দেব৷ এই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা তো আমাদের করতে হবে৷ দেখি, কোথা থেকে তা আনা হবে তা দেখা হচ্ছে৷ মুখ্যমন্ত্রী চান শিক্ষকদের গ্রেড পে ৩৬০০ টাকা করা হোক৷’’ পে-স্কেল নিয়ে আওয়াজ উঠলেও তা এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানান, ‘‘দাঁড়ান নির্দেশ প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন৷’’ যদিও, আজ বিকেল ডট কম প্রতিবেদন প্রকাশ করে আগেই জানিয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড-পে ৩৬০০ টাকা করা হতে পারে৷
সূত্রের খবর, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ৭১০০টাকা থেকে ৩৭ হাজার ৬০০ টাকার করা হতে পারে৷ নয়া এই হার কার্যকর হলে কমপক্ষে ৬ হাজার টাকার বেশি বেতন বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে৷ নয়া হারে বেতন বাড়লে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১১৭০ কোটি টাকা খরচ হবে৷
এবিষয়ে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘দলীয় শিক্ষকদের কাছে গিয়ে বক্তৃতার না করে শিক্ষামন্ত্রী যদি যাঁরা আন্দোলন করছেন সেই আন্দোলনকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে গিয়ে মুখোমুখি বসে কথা বলে সমাধান করতেন সেটা সবচেয়ে ভালো হতো৷ প্রাথমিক শিক্ষকদের পিআরটি স্কেল এবং ১৪ জনের বাধ্যতামূলক বদলির বিষয়ে মৌখিক আশ্বাস না দিয়ে বাস্তবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি এবং এর মাধ্যমেই অনশন আন্দোলন প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারতেন৷ আমি দাবি করছি, শিক্ষামন্ত্রী অবিলম্বে সেই ভূমিকা গ্রহণ করুন৷’’
শিক্ষকদের বার্তা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, ‘‘আপনারা বেতন বৃদ্ধির কথা বলছেন৷ কিন্তু, নিজেদের দায়িত্ব বোধ থাকা উচিত৷ কারণ, ছাত্র-ছাত্রীরা না থাকলে কোনও গুরুত্ব নেই৷ কারণ শিক্ষকদের প্রধান কাজ শিক্ষা দেওয়া৷’’ কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘লোক বলছে শিক্ষকরা বেতন বাড়ানোর জন্য রাস্তায় বসে আছে৷ কিন্তু, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য কেন আপনারা আন্দোলন করছেন না ?’’ জানান, এই মুহূর্তে শিক্ষকরা মাস পয়লা বেতন পান৷ কেন আপনারা এটা নিয়ে কিছু বলছেন না? বলেন, শিক্ষকরা পাওনা চান, কিন্তু দায়িত্ব নেন না৷ আপনারা দায়িত্ব দিন, পাওনাও কেন চাইবেন না কেন? আপনাদেরও এগিয়ে আসবেন৷ এদিন অনশনরত শিক্ষকদের অনশন তুলে নেওয়ার আর্জি জানান৷