কলকাতা: বিধানসভার সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বামেদের সঙ্গে জোট করেও তিনি বিজেপিকে পরাস্ত করতে খড়গপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ এবার এনআরসি-সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকে সামনে রেখে তিনি রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে এককদম হাঁটলেন৷ তিনি কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান৷ সম্প্রতি তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে এই জোটের আবেদন করেছেন৷ আর সেই সঙ্গেই রাজ্য রাজনীতিতে শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা, এবার কি তবে মানস ভুঁইঞার পথেই একটু একটু করে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছেন মান্নান সাহেব? আর সেইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, এবার কি তবে বামেদের সঙ্গে জোট ভেঙে তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধতে চলেছে কংগ্রেস?
কোনও গুজব কিন্তু নয়৷ গতবছরের শেষদিন বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মান্নান নিজে এই চিঠির কথা উল্লেখ করেছিলেন এক সাংবাদিক বৈঠকে৷ তাঁর কথায়, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে বাম-কংগ্রেস যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে তৃণমূলও৷ আর তাই ওই আন্দোলনকে জোরদার করতে তৃণমূলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি৷ এখন প্রশ্ন একটাই, এই 'যৌথতা' শেষ অবধি কি নির্বাচনী জোটে পরিণত হবে? শেষ অবধি ২০১১-র মতো তৃণমূল-কংগ্রেস জোট বিধানসভায় লড়বে একসঙ্গে?
যদিও রাজনৈতিক মহলের মতে, সেদিনের পরিস্থিতি আর নেই৷ সেই জোটের পর তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হতে থাকে তাদের৷ আর তারপর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়তে শুরু করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ ২০১৬-র বিধানসভায় সারদা-নারদা বিধ্বস্ত মমতার প্রধান প্রতিপক্ষই ছিল বাম-কংগ্রেস জোট৷ এমনকি, হালের বিধানসভা উপনির্বাচনে এই জোট একদিকে রাজ্যের শাসকদল, অন্যদিকে বিরোধী বিজেপির সঙ্গে সমানে-সমানে টক্কর দিয়েছে৷ এমনকি ফলাফল বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, বাম-কংগ্রেস জোট বিরোধী ভোট কেটে নিতে না-পারলে বিপুল ভোটে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপিকে পর্যদুস্ত করা অত সহজ হত না তৃণমূলের পক্ষে৷ আর ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই প্রশ্ন উঠেছে, যখন রাজ্যে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী হিসেবে একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠে আসছে এই জোট, তখন কেন তৃণমূলের দিকে ঘেঁষতে শুরু করলেন মান্নান?
সামনেই কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় পুরনির্বাচন৷ যাকে ২০২১-এর মহড়া বলা যেতে পারে৷ এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মহলের অনুমান, একইসঙ্গে মোদি-মমতা দুজনের প্রতিই ক্ষুব্ধ ভোটারদের একটা বড় অংশ বুথে গিয়ে বাম-কংগ্রেস জোটকেই ভোট দিতে চাইবে৷ কারণ, রাজ্যে বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির ক্যারিশমা এখন কার্যত হাওয়া৷ অতএব পাড়ায়-পাড়ায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি আর মাইকবাজির হাত থেকে রেহাই পেতে ভোটাররা এই জোটকেই বেছে নেবে৷ অন্তত তার সম্ভাবনাই প্রবল৷ আর সেক্ষেত্রে আর কিছু না-হোক, কলকাতা পুরসভা যদি তৃণমূলের হাতছাড়া হয়ে যায় একবার, তাহলে আগামী বিধানসভায় জোর ধাক্কা খাবে তৃণমূল৷ দলীয় কর্মীদের মনোবলও ভেঙে যাবে৷ তাই এমতাবস্থায় বাম-কংগ্রেস জোট ভাঙানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই মমতার সামনে৷ মানস ভুঁইঞাকে দিয়ে যার শুরু, আব্দুল মান্নানকে দিয়েই সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে৷ আর তা যদি হয়, তাহলে তাকে নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলতে হয়৷
এই আব্দুল মান্নানের মামলার ভিত্তিতেই সারদাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত৷ যার জেরে মদন মিত্রের জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে রাজীব কুমারের লুকিয়ে বেড়ানো আর শাসকদলের চরম অস্বস্তি৷ আজ এই মান্নানের হাত ধরেই যদি তৃণমূলের সঙ্গে জোটে যায় কংগ্রেস, তাহলে রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা ধরে রাখতে পারবে তারা, সেটাই এখন লাখটাকার প্রশ্ন৷ এক সময়ে এই কংগ্রেসকেই মমতা বলতেন সিপিএমের বি-টিম৷ এবার কি তাহলে বামেরা বলতে শুরু করবেন, কংগ্রেস হল তৃণমূলের বি-টিএম? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি একেই বলে তাহলে?