উদ্ধার দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ব্ল্যাক বক্স, জানেন তিন দশকে ২৭টি বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে নেপাল

উদ্ধার দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ব্ল্যাক বক্স, জানেন তিন দশকে ২৭টি বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে নেপাল

কাঠমাণ্ডু: নেপালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা৷ সবচেয়ে বড় বিভীষিকার ছবি৷ যে ভাবে অবতরণের কয়েক সেকেন্ড আগে ৭২ জন যাত্রীকে নিয়ে ভেঙে পড়ে নেপালের এটিআর-৭২, সেই ছবি দেখার পড় অনেকেই শিউড়ে উঠেছেন৷ এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার হল অভিশপ্ত বিমানের ব্ল্যাক বক্স৷ শের বাথ ঠাকুর নামে বিমানবন্দরের এক আধিকারিক জানান, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে  সোমবার সকালে ব্ল্যাক বক্সটি উদ্ধার করা গিয়েছে৷ 

রবিবার বেলা ১১টা নাগাদ কাঠমান্ডু থেকে পোখরাগামী বিমানটি অবতরণের মাত্র ১০ সেকেন্ড আগে আচমকাই সেতী গণ্ডকী নদীর তীরে লাগোয়া জঙ্গলের উপর ভেঙে পড়ে। ওই ঘটনায় কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে নেপাল সেনা। নিহত যাত্রীদের মধ্যে পাঁচজন ভারতীয়ও রয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল, খারাপ আবহাওয়াই দুর্ঘটনার কারণ৷ পরে নেপালের বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, আকাশ পরিষ্কারই ছিল। এই দুর্ঘটনার পিছনে রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি৷ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর দাবি, সপ্তাহ দু’য়েক আগে উদ্বোধন হওয়া চিন-নির্মিত ওই রানওয়েটি পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অবস্থিত। এদিন প্রথমে পাইলটকে পূর্ব দিকে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পরে পাইলট নিজে পশ্চিম দিকে নামার অনুমতি চান এবং তাঁকে সেই অনুমতিও দেওয়া হয়৷ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, অবতরণের সময় বিমানটি বড় বাঁক নিয়ে ছিল। সম্ভবত, সেই সময়েই পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারান! 

তবে এটাই প্রথম নয়৷ এর আগেও বহু বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে নেপাল। এর পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ৷ দুর্গম এলাকা, খারাপ আবহাওয়া, নতুন বিমানের জন্য বিনিয়োগের অভাব এবং কার্যকরী বিমানগুলির পরিকাঠামোর দিকে যথাযথ নজরদারির অভাবেই নেপালে বারবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। তথ্য বলছে, বিগত ৩ দশকে ২৭টি বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ড্রাগনের দেশ।

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে নেপালের সিনারা বিমানবন্দরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্স সংস্থার একটি বিমান। কিন্তু, অবতরণের আগেই তা ভেঙে পড়ে৷ এই ঘটনায় মারা যান বিমানের ৩১ জন যাত্রী এবং ৪ জন বিমানকর্মী৷

১৯৯২ সালের জুলাই মাস৷ প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই ৪ জন বিমানকর্মী এবং ৯৯ জন যাত্রী নিয়ে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে উড়ান দিয়েছিল থাই এয়ারওয়েজ সংস্থার এয়ারবাস ৩১০। বিমানটি তখন কাঠমান্ডু থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে, একটি পাহাড়ে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে এয়ারবাস ৩১০। মৃত্যু হয় সকলের৷ ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই ফের বিপত্ত। ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের করাচির জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা দেওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স সংস্থার একটি বিমান। কাঠমান্ডু বিমানবন্দর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় সেটি। এই দুর্ঘটনায় মোট ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়৷ 

১৯৯৩ সালের জুলাই মাসের ঘটনা৷ এভারেস্ট এয়ার সংস্থার একটি ডর্নিয়ার বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে৷ বিমানবন্দরে পৌঁছনোর আগেই ভেঙে পড়ে সেটি৷ প্রাণ হারান ১৯ জন৷ 

তবে ১৯৯৩ সালের পরবর্তী ৭ বছর নেপালে কোনও বড়সড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। ২০০০ সালে রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের একটি টুইন ওটার বিমান নেপালের উদ্দেশে উড়ান দিয়েছিল। নেপালের ধানঘাধি বিমানবন্দরে পৌঁছনোর আগেই বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের জানা যায়, ৩ জন বিমানকর্মী এবং ২২ জন যাত্রী এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান৷ 

২০০১ সালের ১২ নভেম্বর। ওই দিন নেপালের রাজপরিবারের ইতিহাসে এক রক্তে রাঙা দিন৷ ওই দিন হেলিকপ্টারে চেপে নেপালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন রাজকন্যা প্রেক্ষা শাহ।  নেপালের পশ্চিমাংশে রারা হ্রদের কাছে পৌঁছতেই তাঁর হেলিকপ্টারটি ভেঙে পড়ে। রাজকন্যা সহ ৬ জন ব্যক্তি এই দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে হ্রদ থেকে রাজকন্যার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ 

২০০৬ সালের জুন মাসে ইয়েতি এয়ারক্রাফ্টের একটি বিমান আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় বিমানের ৬ জন যাত্রী এবং বিমানকর্মীরা মারা যান। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে ফের দুর্ঘটনা৷  ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ সংস্থার তরফে অভিযানে বেরিয়েছিল শ্রী এয়ার হেলিকপ্টার। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর আগেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চপারটি। যাত্রী এবং বিমানকর্মী-সহ মোট ২৪ জনের মৃত্যু হয়।  খারাপ আবহাওয়ার দরুন এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

মাউন্ট এভারেস্ট  ঘুরে বুদ্ধা এয়ার সংস্থার বিচক্রাফ্ট ১৯০০ডি বিমানে চেপে নেপালে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলেন পর্যটকেরা।  কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জেরে  মাঝ আকাশেই ঘটে বিপত্তি। ঘটনাটি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের৷  স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১০ জন ভারতীয় ছিলেন।

 

 

২০১২ সালের মে মাসের ঘটনা। ২১ জন যাত্রীকে নিয়ে  পোখরা বিমানবন্দর থেকে জমসম বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল ডর্নিয়ার বিমান। নেপালের উত্তরাংশে বেশি উচ্চতায় থাকা একটি বিমানবন্দরে নামার চেষ্টা করছিল ওই বিমান। কিন্তু অবতরণের সময় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে সেটি।
নিহত যাত্রীদের ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন ভারতীয় এবং তাঁরা সকলেই তীর্থযাত্রী ছিলেন।

২০১৫ সালের মে মাসে নেপাল ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়৷ চারিকোট এলাকায় ‘সহযোগী হাট’ নামে একটি অপারেশন চালানো হয়। ইউএইচ-১ওয়াই হুয়ে হেলিকপ্টারটি চারিকোট এলাকায় ত্রাণ পৌঁছতে গিয়েছিল। কিন্তু, দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটি৷ মৃত্যু হয় ৮ জনের৷ 

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস৷ ১১ জন যাত্রী নিয়ে নেপালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল এয়ার কাষ্ঠামণ্ডপ এয়ারক্রাফ্টের একটি বিমান। নেপালের কালিকোট জেলার কাছে পৌঁছেই বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ঘটনায় দু’জন বিমানকর্মীর মৃ্যতু হয়৷ ৯ জন যাত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

২০১৮ সালের ১২ মার্চ। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঢাকা থেকে ফিরছিল। পথে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা ছিল বিমানটির। কিন্তু, পাইলট হঠাৎ বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারায়ে ফেলেন এবং ৬৭ জন যাত্রী এবং ৪ জন বিমানকর্মী নিয়ে  বিমানবন্দরের কাছে একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি। এই ঘটনায় ৪৯ জন মারা যান।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। খারাপ আবহাওয়া দেখে আবার নেপালে ফিরছিল এয়ার ডাইন্যাস্টির একটি হেলিকপ্টার। কিন্তু, নেপালে ফেরার পথে একটি পাহাড়ে ধাক্কা মারে সেটি। এই দুর্ঘটনায় ৭ জন মারা যান। জানা যায়, ওই হেলিকপ্টারে ছিলেন নেপালের তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী রবীন্দ্র অধিকারী৷ মৃত্যু হয় তাঁরও৷ 

২০২২ সালের মে মাসে ফের এক দুর্ঘটনা৷  খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই এয়ারপ্লেন সংস্থার একটি বিমান ২২ জন যাত্রী নিয়ে নেপালের উদ্দেশে উড়েছিল।  নেপালের মুসতাং জেলায় পৌঁছতেই  দুর্ঘটনা। পাহাড়ে ঢাকা এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। দুর্ঘটনার ফলে ২২ জন মারা যান। তাঁদের মধ্যে ৪ জন ছিলেন ভারতীয়৷