তপন মল্লিক চৌধুরী: মাত্র ৪০ বছর বয়সে রাজীব গান্ধী ভারতের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে অষ্টম লোকসভার নির্বাচনে রাজীব বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস সংসদের ৫৪২টি আসনের ৪১১টিতে জয়লাভ করে। এই জয় ছিল ভারতীয় সংসদে কংগ্রেসের সর্বকালের রেকর্ড।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার প্রসার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিল্পে সরকারি সাহায্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক আমদানির পরিমাণ হ্রাস, প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্পে কর ও শুল্ক হ্রাস, ব্যবসায়ীদের মূলধন সংগ্রহ এবং আমদানির ওপর আমলাতান্ত্রিক বিধি-নিষেধে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। এ ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলম (পিএলওটিই) এর মতো সশস্ত্র তামিল গোষ্ঠীগুলির বিরোধিতা করে মালদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করারও চেষ্টা করেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার শান্তি প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ এবং পরে সেদেশে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। এই বাহিনীর সঙ্গে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) জঙ্গিগোষ্ঠীর যুদ্ধের জন্য রাজীবকেই দায়ী করা হয়।এ ছাড়া রাজীবের অনুমতিতেই জঙ্গি কার্যকলাপের রাশ টানতে পাঞ্জাবে পুলিশী ও সামরিক অভিযান চালানো হয়। সেই সময় পুলিশ ও জঙ্গি উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও আনা হয়।
কিন্তু ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে কংগ্রেসের। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস বিরোধীরা স্লোগান তুলেছিল ‘গলি গলি ম্যায় শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। সেই সময় রাজীবের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন মান্ডার রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।
প্রথমে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৮৭-র জানুয়ারিতে রাজীব তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পরে ভিপি সিং ১৯৮৬ সালে বোফর্স কোম্পানির সাথে হওয়া সামরিক চুক্তি নিয়ে অভিযোগ তোলেন। এদিকে দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সাথে তার মত বিরোধ দেখা দিতে থাকে। একটা পর্যায়ে রাজীব গান্ধী তাকে মন্ত্রীসভা থেকে বহিষ্কার করেন। অপমান সইতে না পেরে ভিপি সিং লোকসভার সদস্যপদ এবং কংগ্রেসের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।
এরপর তিনি আরিফ মুহম্মদ আর অরুণ নেহেরুকে নিয়ে জনমোর্চা দল গঠন করে; কয়েকদিন পরে, এলাহাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে উপ-নির্বাচনে জিতে আবার লোকসভায় ফেরেন। এরপর তার গঠিত জনমোর্চা দল জনতা দলের সাথে সামিল হয়। ১৯৮৮ সালে জনতা দলের উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দল মিলে জাতীয় মোর্চা বা রাষ্ট্রীয় মোর্চা গড়ে।
১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি বোফর্স কেলেঙ্কারি রাজীবের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দেয়। তখন বিরোধী দলগুলো জনতা দল নামে একটি জোট তৈরি করে। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে কংগ্রেসের। নির্বাচনে বিরোধী দলনেতা মনোনীত হলেন। তবে জোটে মতানৈকের কারণ সরকার ভেঙ্গে যায়। ১৯৯১ সালে পুনরায় নির্বাচন ঘোষিত হয়। ওই বছরের ২১ মে রাজীব মাদ্রাজ থেকে ৩০ মাইল দুরে শ্রীপেরুম্বুদুরে লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার অভিযানে যান। সেখানে এক সভায় গুপ্ত ঘাতকের হামলায় নিহত হন।
ওদিকে ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতেই বোফর্স তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় সুইস ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ২০০৪ সালে দিল্লি হাইকোর্ট জানিয়েছিল, বোফর্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজীব গান্ধীর সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।