তপন মল্লিক চৌধুরী : এ রাজ্যে বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে জঙ্গলমহল ছিল মাওবাদীদের এলাকা। মাওবাদীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে নেয়। মাওবাদীদের তৎপরতায় অশান্ত হয়ে ওঠে জঙ্গলমহল। ২০১১ তে এ রাজ্যের শাসনক্ষমতার হাতবদল হয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে বছর বিধানসভা নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদীদের পাশে দাঁড়ান। ঘোষণা করেন, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে মাওবাদীদের সমস্যার সমাধান করবেন। ঘোষণার পর মাওবাদীরাও এসে দাঁড়ান মমতার পাশে।
ক্ষমতায় এসে মমতা মুক্তি দেন কিছু মাওবাদীকে। বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করিয়ে অনেককে ফিরিয়ে আনেন। মমতার ওই পদক্ষেপে জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরতে শুরু করে। কিন্তু মাওবাদীরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনেক মাওবাদী নেতাকে মমতা মুক্তি দেননি। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই অব্যাহত থাকে। মাওবাদী নেতা কিষেনজি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন। কিষেনজির মৃত্যুর পর কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়ে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের তৎপরতা।
শোনা যাচ্ছে ফের শুরু হয়েছে মাওবাদী তৎপরতা। বেলপাহাড়িতে গত ২০ দিনের মধ্যে ৪টি ঘটনায় মাওবাদী তৎপরতার প্রমাণ মিলেছে। শুক্রবার সকালে বেলপাহাড়িতে এক ঠিকাদারকে হুমকি দিয়ে পোস্টার পাওয়া যায়। সেদিনই বেলপাহাড়ির ঢাঙ্গিকুসুমে ঘুরতে আসা একটি পর্যটকদলের কাছ থেকে ৭ জন সন্দেহভাজন মাওবাদী মোবাইল ছিনিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। তাঁদের দাবি, সশস্ত্র মাওবাদী দলের মধ্যে ৩ জন মহিলা, ৪ জন পুরুষ। দিন কয়েক আগে পচাপানিতে মাওবাদীদের নাম করে হুমকি চিঠি পেয়েছিলেন একজন। তাঁর বাড়ির সামনে গুলি চালানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ অবশ্য মাওবাদী যোগ মানতে চায়নি।
তবে গত শনিবার ঝাড়গ্রামে রাজ্য পুলিস কর্তাদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন ডিজিপি বীরেন্দ্র। সেই বৈঠকে ছিলেন এডিজি (পশ্চিমাঞ্চল), আইজি বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের পুলিস সুপার, ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিস সুপার (অপারেশনস), বাঁকুড়ার এসপি ও বেলপাহাড়ির ডিএসপি।
ঝাড়খন্ড রাজ্য লাগোয়া ছোট পাহাড় ও জঙ্গলবেষ্টিত তিনটি জেলা নিয়ে জঙ্গলমহলের অবস্থান। জেলা তিনটি হলো পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। গত আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে নতুন তৎপরতা। দল ধরে এলাকায় শুরু হয়েছে টহল। গ্রামে গ্রামে পড়ছে পোস্টার। কোনো কোনো গ্রামে টাকা চেয়ে শুরু হয়েছে হুমকি।
এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসার পর তৎপর হয়ে পড়ে রাজ্য পুলিশ। গতকাল শনিবার রাজ্য পুলিশের ডিজি বা মহাপরিচালক বীরেন্দ্র ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করেন। বৈঠক করেন ঝাড়গ্রামের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, এই জঙ্গলমহল থেকে কাশ্মীরে ফিরে যাওয়া ৩ কোম্পানি কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী বা সিআরপিএফকে ফের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে জঙ্গলমহলে।
কিষেণজির মৃত্যুর পর জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতা ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও কিছুদিন পর মাওবাদীদের অন্য নেতারা গোপনে শুরু করেন তৎপরতা। এর নেতৃত্ব দেন মাওবাদী নেতা আকাশ। সেই তৎপরতা এখনো চলছে গোপনে জঙ্গলমহলজুড়ে। তবে এই মাওবাদীরা দিনের বেলা জঙ্গলমহলে তৎপরতা চালালেও রাতের বেলা তাঁরা পাশের ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভুম জেলায় রাত কাটান। এভাবেই চলছে মাওবাদীদের তৎপরতা।
মনে হচ্ছে ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসাতেই ফের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে মাওবাদীরা। সূত্রের খবর অনুযায়ী, গত ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন লাবণী গ্রামে কালো পতাকা তুলেছে মাওবাদীরা। ২৭ আগস্ট পচাপানি গ্রামে টাকা চেয়ে পোস্টার লাগায়। তারা এক গ্যাস ডিলারের কাছে টাকা চেয়ে তাঁর বাড়িতে গুলিবর্ষণও করে। ৩ সেপ্টেম্বর বেলপাহাড়ির ঢাঙ্গিগ্রামে পর্যটকদের মোবাইল ছিনতাই আর ৪ সেপ্টেম্বর সিন্দুরিয়ার রাস্তায় ঠিকাদার সৌরভ রায়ের কাজ বন্ধ করার হুমকি দিয়ে পোস্টার লাগায়। এসব ঘটনার মাধ্যমে মাওবাদীরা জানান দিতে শুরু করেছে যে তারা এখনো তৎপর। পাশাপাশি এটাও ঘটনা, এখনও জঙ্গলমহলের আদিবাসী সমাজে বঞ্চনার নানা অভিযোগ রয়েছে। মাওবাদীরা ফের বিভিন্ন ব্যানারে সংঘবদ্ধ হচ্ছে।