তপন মল্লিক চৌধুরী : পাঁচ দশক ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন রামবিলাস পাসোয়ান।১৯৮০–৯০–এর দশক থেকেই রামবিলাস দলিতদের নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন।বিহারের মোট ভোটের ১৭ শতাংশ দলিত কোটার।আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদবের জমানাতেও তা বজায় ছিল। লালুপ্রসাদ নিজেকে নিপীড়িতদের নেতা দেখালেও, দাপট ছিল যাদবদের। তখনই দলিত–তাস খেলে লোকসভা ভোটে রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন রামবিলাস।
লালুপ্রসাদ দলিত ভোট হারানোর পর ওই ভোট ব্যাঙ্কই পাখির চোখ ছিল নীতীশ কুমার ও রামবিলাসের। নীতীশ কুমার ২০০৫ সালে ক্ষমতা লাভের পর মহাদলিতদের নিয়ে ‘নীচ’ ভোট ব্যাঙ্ক গড়েছিলেন। ২০টি দলিত উপবর্ণের জায়গা হয় তাতে। কিন্তু পাসোয়ানরা সেখানে জায়গা পায়নি।২০১৫ সালে বিহার বিধানসভা ভোটে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল লোক জনশক্তিকে। বিজেপি–র সঙ্গে জোট করে পাসোয়ান তার ফায়দা তোলেন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে।
১৯৬৯ সালে রাজনীতির ময়দানে সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির হয়ে রাজনীতির ময়দানে নামেন তিনি। ওই বছরই বিহার বিধানসভায় নির্বাচিত সদস্য হিসেবে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে লোকদল স্থাপন হওয়ার পর সেখানে যোগ দেন তিনি। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির হয়ে হাজিপুর কেন্দ্র থেকে লোকসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময় বিরোধী মুখ ছিলন তিনি।জয়প্রকাশ নারায়ণের একান্ত অনুগত হয়ে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন তিনি। গোটা জরুরি অবস্থার মেয়াদেই তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। পরে প্রথমে লোক দলে যোগ দেন, তার পর মোরাজি দেশাইয়ের সঙ্গে হাত মেলান।
অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমল থেকেই একাধিক মন্ত্রিত্ব সমলেছেন তিনি। কেন্দ্রে শাসক পালটালেও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দরুন শিবির পালটে মন্ত্রিত্ব পেয়ে যেতেন তিনি। সদ্য বিহার ভোট নিয়ে কেন্দ্রের শাসকদল ও রাজ্যের শরিকদল বিজেপির সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয় তাঁর পার্টির। তারপরই বিধানসভা নির্বাচনে ‘একলা’ চলার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ানের দল লোকজনশক্তি পার্টি।তবে বিজেপির সঙ্গে আসন সমঝোতা বজায় রাখছে তার দল। তাছাড়া জাতীয় স্তরে যে বিজেপির সঙ্গে যে সমঝোতা বজায় থাকছে, সেকথা সরকারিভাবেও জানানো হয়েছে এলজেপির তরফে।
যদিও বিহারে লোক জনশক্তি পার্টির ভোট মাত্র ৫ শতাংশ।বিহারে তাঁকে দুসাড় বলা হয়, তফসিলি জাতির পাসোয়ান। ২০১৪ সালে বিজেপি ২৯.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। পাসোয়ান ছাড়াও উপেন্দ্র কুশওয়াহার ৩ শতাংশ ভোট ছিল। সব মিলিয়ে এনডিএ পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ। বিজেপি পেয়েছিল ২২ আসন, লোকজনশক্তি পার্টি ৬, কুশওয়াহার পার্টি ৩। কুশওয়াহা আগেই মোদিকে ছেড়ে চলে গেছেন, পাসোয়ান আরও বেশি আদায় করে নিলেও, বিহারবাসী জানেন ক্ষমতার দিকে ঢলে পড়তে রামবিলাশের বিন্দুমাত্র দেরি হয় না। নীতীশ কুমার কুর্মিদের নেতা, তাঁর হাতেও মাত্র ৩ শতাংশ ভোট। তবু তিনি ১৭টি আসন আদায় করে নিয়েছেন। অর্থাৎ বিজেপি জানে ২৯ শতাংশ ভোট তারা ধরে রাখতে পারবে না।
গত লোকসভায় ২২ আসনে জেতা দল ঠিক সেই কারণেই ১৭–য় নেমে যায়। এটা ঘটনা যে, বিহারের ৪০ আসনে প্রতিষ্ঠান–বিরোধিতার জোড়া ধাক্কা সামলাতে হয় এনডিএ–কে। বিহারে ছিলেন নীতীশ, দিল্লিতে মোদি। ১৭ আসনের মধ্যে অর্ধেকও বিজেপি–র জুটবে না, যদি তাদের ভোট ৫ শতাংশ কমে যায়। দিল্লি দখলের লক্ষ্যে হিসেবটা বিহারে অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। কারণ ২০১৪ সালে প্রায় ৩১.৫ শতাংশ ভোট পেয়েও আরজেডি, নীতীশ, এনসিপি সাকুল্যে ৭টি আসন পেয়েছিল। মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল নীতীশের দল। আরজেডি ৪, এনসিপি ১।
এবার ছবিটা বদলাবে। বিয়াহারের সামাজিক সমীকরণ সে কথাই বলে।বিধানসভা নির্বাচনেআরজেডি পেয়েছিল ১৮.৪ শতাংশ ভোট। এবার তেজস্বীর তেজে ভোট বাড়বে, উপনির্বাচনে তার ইঙ্গিত মিলেছে।বিজেপি–র ভোটব্যাঙ্কে ৬% ভূমিহার, ৩% রাজপুত, ৫% ব্রাহ্মণ আর ৫% কায়স্থ। ইউপিএ শিবিরে যাবে যাদবদের ১৪%, মুসলিমদের ১৭% ভোটের বেশিটাই। সেই সঙ্গে আছে দলিত মুস্হহরদের ৩%, যাঁদের নেতৃত্বে জিতনরাম মাঝি। কুশওয়াহাদের ভোট ৮%। তাছাড়াও মাল্লা বা নিষাদদের ৫% ভোট ঝুঁকছে তেজস্বীদের দিকে। এই অঙ্কটা ঠিকই কষে দিয়ে গেছেন রামবিলাস। বেছে নিয়েছেন রাজ্যসভার নিরাপদ বিকল্প। যদিও তাঁর দল নিছকই পারিবারিক। স্ত্রী রিনা দাঁড়াবেন, ছেলে চিরাগ দাঁড়াবেন আর ভাই পারস। রামবিলাস নেই কিন্তু তাঁর প্রভাবটা এবারও কাজ করবে।