নিজস্ব প্রতিনিধি: প্রয়াত ওআরএস-এর জনক প্রফেসর দিলীপ মহলানবিশ। কিংবদন্তি এই বাঙালি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে তাঁর আবিষ্কৃত ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন’ বা সংক্ষেপে ওআরএস। ডিহাইড্রেশন বা শরীর থেকে জল প্রচুর কমে গেলে মানুষের মৃত্যু হয়। আর সেই অবস্থায় নুন-চিনির সঙ্গে বেকিং সোডা মিশ্রিত মেশানো জল খাইয়ে রোগীকে ঠিক রাখা হয়। এই পথ প্রথম দেখিয়েছিলেন তিনি। একেবারে প্রচার বিমুখ এই চিকিৎসক-বিজ্ঞানী শনিবার রাতে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
শরীর থেকে অত্যাধিক জল বেরিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইনের ব্যবস্থা করা কতটা যে কঠিন তা সকলেই জানেন। ঠিক সেই জায়গা থেকে নুন-চিনি মেশানো জল অর্থাৎ ওআরএস দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতে প্রাণ বাঁচে সেই পথ দেখিয়েছিলেন এই কৃতী বঙ্গসন্তান। একটা সময় আফ্রিকার বহু শিশু ও মানুষের এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচান তিনি। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেই সঙ্গে নীরবে করেছেন অধ্যাপনার কাজ। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের যে ঘরে বসে এই আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, সেটি আজ পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষিত করা হয়েছে। জানা গিয়েছে বিশ্বব্যাপী তাঁর তৈরি ওআরএস ৭০ মিলিয়নের বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। যাদের অধিকাংশ শিশু। তবে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কারও কাছ থেকেই সেভাবে স্বীকৃতি পাননি তিনি। এই অসাধারণ আবিষ্কারের পরেও তিনি বরাবর লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন।
১৯৩৪ সালে জন্ম হয় এই কিংবদন্তি চিকিৎসক বিজ্ঞানীর। অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে তাঁর জন্ম হয়। পরে তিনি এপার বাংলায় চলে এসে বরাহনগর এবং শ্রীরামপুরে বসবাস করতে শুরু করেন। তবে জীবনের শেষ ভাগটা তিনি কাটিয়েছেন সল্টলেকে। ১৯৬৪ সাল থেকে ওআরএস সংক্রান্ত গবেষণার কাজ তিনি শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে জন হপকিন্স মেডিক্যাল জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বিশ্ব বিখ্যাত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পত্রিকা ‘লানসেট’ তাঁর গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বনগাঁ সীমান্থে বহু কলেরা আক্রান্ত ওআরএস খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই সময় ড্রামে করে ওআরএস বনগাঁ সীমান্তে নিয়ে যেতেন তিনি।
কিন্তু যে কোনও কারণে তখন এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেয়নি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’। পরবর্তীকালে আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নয়ের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়েরিয়া সংক্রান্ত কর্মসূচির মেডিক্যাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া আইসিডিডিআর বাংলাদেশের অধিকর্তার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এছাড়া ১৯৯৪ সালে রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের বিদেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মহালানবিশ। ২০০২ সালে ‘পলিন’ পুরস্কার এবং ২০০৬ সালে পান প্রিন্স মাহিডল অ্যাওয়ার্ড। তবে গত কয়েক বছর ধরে অসুস্থতার কারণে সেভাবে রোগী দেখতে পারতেন না। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বঙ্গের চিকিৎসক মহল। চিকিৎসকদের কথায় ডা. দিলীপ মহলানবিশ চলে গেলেও তাঁর মহান আবিষ্কার সারা জীবন থেকে যাবে। কলেরা, ডায়েরিয়ার পাশাপাশি ডিহাইড্রেশন সংক্রান্ত বহু অসুখের ক্ষেত্রে তাঁর ওআরএস জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবে কাজ করে চলবে।
কিন্তু ওয়াকিবহল মহলের প্রশ্ন, এত বড় আবিষ্কারের পরেও সেটি কেন নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়নি? কেন রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি? পশ্চিমবঙ্গে বহুদিন ধরেই ‘বঙ্গ সম্মান’ পুরস্কার প্রদান চালু হয়েছে। কিন্তু এই কৃতি বাঙালি চিকিৎসককে সেই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে কিনা, তা জানা নেই কারও। সব সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গিয়েছেন এই কৃতী বাঙালি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। আর সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু দিলীপ মহালানবিশের কথা সংবাদ মাধ্যমে সেভাবে এতদিন কেন উঠে আসেনি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ওয়াকিবহাল মহল। এই কৃতী বঙ্গ সন্তানের নাম ক’জন মানুষ জানতেন? সব মিলিয়ে তাঁর মৃত্যু অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল।