কী ভাবে তৈরি হল ভারতের জাতীয় পতাকা? কবে গৃহীত হল? জানুন বিবর্তনের ইতিহাস

কী ভাবে তৈরি হল ভারতের জাতীয় পতাকা? কবে গৃহীত হল? জানুন বিবর্তনের ইতিহাস

নয়াদিল্লি: এই বছর স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপন করতে চলেছে ভারত৷ দেশজুড়ে পালিত হবে আজাদি কা অমৃত মহোৎসব৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রত্যেক নাগরিককে তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল ফটো বদলে ত্রিরঙ্গা করার আবেদন জানিয়েছেন প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ সেই সঙ্গে প্রতিটি ঘরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আর্জিও জানিয়েছেন তিনি৷ 

আরও পড়ুন- দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ার পথে নীতীশ, নিঃসঙ্গ বিজেপি

কিন্তু, অনেকেই হয়তো জানেন না, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৪০ বছর আগে উত্তোলিত হয়েছিল জাতীয় পতাকা৷ তবে আজ যে ত্রিরঙ্গা আমরা চিনি, শুরুতেই তেমনটা ছিল না৷ বারবার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ভারত পেয়েছে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা৷ কেমন ছিল জাতীয় পতাকা তৈরির সেই ইতিহাস? কোন কোন রূপে দেখা গিয়েছিল ভারতের পাতাকাকে? কারাই বা সেই পতাকার নকশা এঁকেছিলেন? স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস৷ 

সাল ১৯০৫৷ ভারত তখনে ব্রিটিশ রাজ৷ বঙ্গ ভঙ্গ ঘোষণা করেন লর্ড কার্জন৷ বিরোধিতায় গর্জে ওঠে বাঙালি৷  প্রবল জাতীয়তাবোধ থেকে জন্ম নেয় জাতীয় পতাকার চাহিদা যদিও আগের বছর অর্থাৎ ১৯০৪ সালে ভগিনী নিবেদিতা জাতীয় পতাকার একটি নকশা তৈরি করেছিলেন। হলুদ আর লাল রং-এর সেই পতাকার মাঝখানে ছিল ইন্দ্রদেবের বজ্রের ছবি এবং দু’পিঠে বাংলায় লেখা ‘বন্দে মাতরম্‌’। সেখানে লাল রঙের তাৎপর্য ছিল দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম৷ আর হলুদ রং রাখা হয়েছিল জয়যাত্রার সূচক হিসাবে৷ ইন্দ্রদেবের বজ্রকে ছিল শক্তি বা পরাক্রমের প্রতীক৷

ভারতের মাটিতে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় ১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট, পারসি বাগান স্কোয়ারে (বর্তমানে গিরিশ পার্ক)। এই পতাকাটিকে ‘দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ’ নামেও পরিচিত৷ এই পতাকাটির নকশা এঁকেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন্দ্র প্রসাদ বোস এবং হেমচন্দ্র কানুনগো। ওই পতাকা ছিল ত্রিরঙ্গা৷ তবে গেরুয়া, সাদা, সবুজ নয়৷ একদম উপরে ছিল সবুজ, তারপর হলুদ, নীচে লাল। সবুজ রঙের মধ্যে ছিল আটটা অর্ধ প্রস্ফুটিত পদ্ম, হলুদে ছিল দেবনাগরী হরফে লেখা ‘বন্দে মাতরম্‌’ আর লালে ছিল একটি অর্ধচন্দ্র এবং একটি সূর্য। যদিও এটি ছিল  আনঅফিসিয়াল৷ 

flag

দ্যা ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ’-এর উপর ভিত্তি করে ১৯০৭ সালে একটি নকশা তৈরি করেছিলেন ম্যাডাম ভিকাজি কামা, বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং শ্যামজি কৃষ্ণ ভার্মা। এই পতাকাটিকে ‘দ্য কামা ফ্ল্যাগ’ও বলা হয়ে থাকে। এর উপরে ছিল গেরুয়া, মাঝে হলুদ এবং তলায় সবুজ। মাঝের হলুদ রঙে আটটা পদ্মের স্থানে আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ইঙ্গিত করে ছিল সাতটা পদ্ম৷ সেই সঙ্গে দেবনাগরী হরফে লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম্‌’৷ সবুজের মধ্যে ছিল একটা সূর্য আর একটা অর্ধচন্দ্র৷ এর উপর ছিল একটা তারা। ১৯০৭ সালে এই পতাকাটি ম্যাডাম কামা এবং কয়েকজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বার্লিনে উত্তোলন করেন৷ এবং এটিই বিদেশে উত্তোলিত হওয়া ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা।

flag

এরপর ১৯১৬ সালে হোমরুল আন্দোলন চলাকালীন ডঃ অ্যানি বেসান্ত আর লোকমান্য তিলক আরও একটি পতাকার নকশা তৈরি করেন। এই পতাকায় পাঁচটা লাল আর চারটে সবুজ লাইন ছিল, উপরে ডানদিকের কোণে ছিল একটা অর্ধচন্দ্রর উপরে একটা তারা আর বাঁ দিকে উপরের কোণে আঁকা ছিল ‘ইউনিয়ন জ্যাক’৷ তার ঠিক তলা থেকে ডান দিক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটা তারা।

flag

 

এর পর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোটা দেশকে নাড়া দিয়ে যায়৷ ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধীর পরিচালনায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সময়ে মহাত্মা গান্ধী প্রবলভাবে একটা জাতীয় পতাকার অভাব অনুভব করেছিলেন। ওই বছরেই বেজওয়াড়ায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কমিটি মিটিং-এ পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া মহাত্মা গান্ধীর কাছে জাতীয় পতাকার একটা নকশা প্রস্তাব করেন৷ সেখান ছিল লাল এবং সবুজ রঙ। মহাত্মা গান্ধী সেই নকশা দেখার পর সেখানে সাদা রং এবং তার মাঝে চরকা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন।

flag

গান্ধীজির পরামর্শ অনুযায়ী নতুন করে পতাকার নকশা তৈরি হয়। গান্ধীজির ব্যাখ্যা অনুযায়ী পতাকার একদম তলায় থাকা লাল রং দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে৷ কারণ তারা ছিল সংখ্যাগরিস্ট৷ মুসলিমদের বোঝাতে সবুজ রঙ এবং একদম উপরে ব্যবহৃত সাদা রঙ ছিল দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতীক। স্বনির্ভর ভারত বোঝাতে গান্ধীজি পতাকায় আঁকা হয় চরকা। 

flag

এর ঠিক দশ বছর পর ১৯৩১ সালে পি. ভেঙ্কাইয়া ফের জাতীয় পতাকার নকশা পাল্টান। হিন্দু সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করতে লাল রঙ পাল্টে হয় গেরুয়া এবং স্থান পায় পতাকার একদম উপরে। পাশাপাশি এর তাৎপর্যও পরিবর্তিত হয়। সাদা রঙ চলে আসে মাঝখানে এবং তা ব্যবহার করা হয় সত্যকে ইঙ্গিত করার জন্য। আগের মতোই পতাকার মাঝখানেই রাখা হয় চরকা৷ সবশেষে মুসলমান সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করতে একেবারে তলায় রাখা হয় সবুজ রঙ৷ একইসঙ্গে সবুজ ব্যবহার করা হয়েছিল উর্বরতার প্রতীক হিসাবেও৷ 

national flag

অবশেষে ১৯৪৭ সালে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু প্রস্তাবে নতুন করে তৈরি হয় জাতীয় পতাকা৷ সেই পতাকায় সমান্তরালভাবে তিনটে রঙ রাখা হয়। উপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা এবং তলায় গাঢ় সবুজ৷ মাঝখানের সাদা রঙে চরকার বদলে আনা হয় অশোকের ধর্মচক্র। এই পতাকায় ১৯৩১ সালে পি.ভেঙ্কাইয়া নির্মিত পতাকার রঙের তাৎপর্যগুলোকেই বজায় রাখা হয়৷ শুধুমাত্র চরকার স্থানে আসে অশোকের ধর্মচক্র। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই, সাংবিধানিক সভায় গৃহীত হয় বর্তমান ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা৷