বিবস্বান বসু: বাংলার বিধানসভা যুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ানো বেশির ভাগ তারকা প্রার্থীই জয়লাভ করেছেন৷ সায়নী ঘোষ, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো হাতে-গোনা দু’-একজন বাদ দিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতই শক্ত করেছে বঙ্গের সেলেব মহল৷ উলটো দিকে অবশ্য ভোটের আগেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লেখানো হিরণ ছাড়া কেউই পদ্মের ঘরে আলো ফেলতে পারেননি৷ পায়েল থেকে পার্নো- কারও ভাগ্যেই ছেঁড়েনি শিকে৷ খোলেনি বিধানসভার দরজা৷ তা হলে কী এমন ঘটল যে, তৃণমূলের অধিকাংশ তারকা প্রার্থী জয়ের মুখ দেখলেও বিজেপির ভোটবাক্সে ছাপ ফেলল না রুদ্রনীলদের যশ!
নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, আসলে উত্তরটা খুবই সহজ৷ শেষ বিচারে নবান্ন দখলের অঙ্ক যেহেতু মমতার প্রত্যাবর্তনের লড়াইয়ের থেকেও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রো মোদি বনাম নো মোদি, সেখানে কোনও কাজই করেনি তারকার গ্ল্যামার কোশেন্ট৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেখানে বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভরসা রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর, সেখানে জয়ী প্রার্থীদের নামগুলো নেহাতই ঘটনাচক্রে রাজ চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, সোহম চক্রবর্তী বা জুন মালিয়া৷ তারকার ছটায় একটি বাড়তি ভোটও কোনও ফুলের শোভা বাড়ায়নি, যা হয়েছে সবই হয় দিদির পক্ষে বা মোদির বিপক্ষে৷
বঙ্গে অতীতে যে সেলেব প্রার্থীরা ভোটে দাঁড়াত না তা নয়, তবে তা ছিল নেহাতই ব্যতিক্রম৷ অনুপ কুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়দের মতো যাঁরা বামেদের হয়ে ভোটযুদ্ধে নামতেন তাঁদের মোটের ওপর কোনও না কোনও ভাবে দলীয় সংযোগ ছিল৷ অন্য দিকে, তৃণমূলের হাত ধরে তাপস পাল, শতাব্দী রায়রা ভোটের ময়দানে নামলেও, সেটাও এতটা ঢালাও ছিল না৷ কিন্তু ২০১১ বা তৎপরবর্তী সময়ে দক্ষিণি সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিদির ডাকে ভোটবাজারে নেমে পড়েছেন তারকা প্রার্থীরা৷ তার সুফলও হাতেনাতে পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাঁকুড়া বা ঘাটালের লাল দুর্গে বাসুদেব আচারিয়া বা গুরুদাস দাশগুপ্তদের মতো বর্ষীয়ান প্রার্থীরা স্রেফ ঝলসে যান তারকার জৌলুসে৷ সাংসদ হয়ে যান মুনমুন সেন, দেব বা সন্ধ্যা রায়রা৷ আসলে হারা বা কঠিন আসনে তারকা প্রার্থী দাঁড় করানোর দ্বৈত সুবিধা রয়েছে৷ তারকার গ্ল্যামারে যদি হারা আসন জিতে নেওয়া যায়, তা হলে সেটা বোনাস৷ আর যদি না-ও হয়, তা হলেও হারের দায় সরাসরি দলের ঘাড়ে এসে পড়ে না, তারকা প্রার্থীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে পেরিয়ে যাওয়া যায় যাবতীয় সমালোচনার ঝড়৷
এই ফর্মুলা বেশ কিছুদিন ধরেই ডিভিডেন্ড দিচ্ছে তৃণমূল নেত্রীকে৷ তাই একুশের কঠিন ভোটযুদ্ধেও একই টোটকা ব্যবহার করতে পিছপা হননি তিনি৷ বিশেষত, যেখানে উনিশের লোকসভা ভোটের ধাক্কার বিচারে একশো কুড়ির বেশি বিধানসভা আসনে পিছিয়ে তৃণমূল৷ উলটো দিকে, প্রতিপক্ষ বিজেপিও হেঁটেছে তারকার হাত ধরে বাজিমাত করার পথে৷ অবশ্য তাদের ক্ষেত্রে কঠিন আসন গ্ল্যামার দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার অঙ্ক কাজ করেছে নাকি ২৯৪ আসনে নিজেদের লোক দাঁড় করানোর ক্ষমতা না-থাকায় শূন্যস্থান পূরণ করতে দলবদলুদের পাশাপাশি বেশ কিছু আসনে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওপর বাজি ধরতে হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ফলাফল বলছে, মানুষ যতই যশকে দেখে উদ্বেল হোন না কেন, পায়েল-শ্রাবন্তী-তনুশ্রীর রোড শোয়ে ভিড় উপচে পড়ুক না কেন, গেরুয়ার গ্ল্যামার ব্রিগেডে হিরো একমাত্র হিরণই৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে, সায়নী-কৌশানির মতো ব্যতিক্রম বাদ দিলে জোড়াফুলকে ‘লাভলি’ ফলাফল দিয়েছেন রাজ চক্রবর্তী-জুন মালিয়ারা৷ ব্যারাকপুর, মেদিনীপুরের মতো বেশ কিছু পিছিয়ে থাকা আসন এসেছে তৃণমূলের ঝুলিতে৷ কিন্তু তার জন্য কি এক ছটাকও বাড়তি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন এহেন সেলেবরা? তাঁদের তারকার জৌলুস কি আদৌ কোনও বাড়তি মাইলেজ দিয়েছে নাকি তাঁরাও আলোকিত মমতার আলোয়?
সম্ভবত দ্বিতীয়টাই সত্যি৷ তা যদি না হত, তা হলে এতটা অন্ধকারে ডুবে যেত না বিজেপির তারকা সমাহার, খেলা ঘুরত গ্ল্যামারেই৷ বাস্তবে তা হয়নি, কারণ, মানুষ ইভিএমে বোতাম টিপেছেন একটাই মাপকাঠিতে, তাঁরা মোদিকে চান নাকি মমতাকে? বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি হোক বা অন্য কোনও কারণ, যেখানে মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেখানে জয়ের হাসি হেসেছেন তৃণমূলের প্রার্থীরা৷ আর যেখানে মানুষ বিজেপিকেই চেয়েছেন, সেখানে জিতেছেন গেরুয়া প্রার্থীরা৷ আর তাই হিরণ যেমন কোনও তারকা নন, নিছক পদ্মের প্রতিনিধি হিসেবেই বিধায়ক হয়েছেন, তেমনই কাঞ্চন মল্লিক, সোহম চক্রবর্তী, লাভলি মৈত্রদের তারকা পরিচয় গৌণ হয়ে জয়ের নেপথ্যে মুখ্য কারণ একটিই- তাঁরা দিদির সৈনিক৷ -ফাইল ছবি