বিজেপি আগে বললে দ্রৌপদীকে সমর্থনের ভাবনা, দেরিতে বোধোদয়? নাকি নেপথ্যে ভোটব্যাঙ্ক!

বিজেপি আগে বললে দ্রৌপদীকে সমর্থনের ভাবনা, দেরিতে বোধোদয়? নাকি নেপথ্যে ভোটব্যাঙ্ক!

নিজস্ব প্রতিনিধি:  পরপর দু-দুবার ঘটা করে বিরোধী জোট বৈঠক করে রাষ্ট্রপতি পদে যশবন্ত সিনহার নাম ঠিক করেছে। আর যশবন্ত সিনহার আগেই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পেশ করেছেন বিজেপি তথা এনডিএ প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু। উল্লেখ্য রাষ্ট্রপতি পদে যশবন্তের নাম মূলত প্রস্তাব করেছিল তৃণমূল। সেই নামে বিরোধীরা সিলমোহর দেয়। অথচ এখন খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন বিজেপি যদি আগে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম তাঁদের জানাতেন তাহলে তাঁরা হয়ত তাঁকেই সমর্থন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই মমতার এই ভোলবদল নিয়ে উঠছে বহু প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবেই তিনি যে এ কথা বলেছেন তা নিশ্চিত।

বিষয়টি নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কি বলেছেন? শুক্রবার  কলকাতায় ইসকনের রথযাত্রার সূচনা অনুষ্ঠানে এসে মমতা বলেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের ঘটনার পরে দ্রৌপদী মুর্মুর জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। বিরোধীরা সবাই এখন যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি সেটাই মেনে চলব।’’ দ্রৌপদীকে সমর্থনের প্রশ্নে মমতা স্পষ্ট করে দেন যে, কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা সব বিরোধী দল একসঙ্গেই নেবে। সেই সূত্রে তিনি আরও বলেন, ‘‘আগে দ্রৌপদীর নামই বলেনি। আগে থেকে যদি বিজেপি জানাত যে একজন আদিবাসী মহিলাকে তারা প্রার্থী করছে তা হলে আমরাও চেষ্টা করতাম। বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ১৭টা দল মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতেই পারত। কিন্তু বিজেপি শুধু আমাদের সাজেশনটা জানতে চেয়েছিল, ওদের সাজেশনটা জানায়নি। বৃহত্তর স্বার্থে আমি সব সময় ঐকমত্যের পক্ষে। কিন্তু ১৭-১৮টা রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেই সিদ্ধান্ত থেকে সবাই না বললে আমার পক্ষে একা ফিরে আসা সম্ভব নয়।’’ সেই সঙ্গে মমতা বলেছেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্রৌপদীর জয়ের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। অথচ এমন একটা সময় তিনি একথা বললেন যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য রাজ্য সফরে বের হচ্ছেন যশবন্ত। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট মানসিকভাবে যশবন্তকে এদিন অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছেন মমতা।

গত লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলে ধরাশায়ী হয়েছে তৃণমূল। যদিও একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ক্ষত তৃণমূল মেরামত করে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আদিবাসী সমাজের নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে তারা প্রকৃত অর্থেই দলিত, পিছিয়ে পড়া, আদিবাসী অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি কতটা দরদী। বিষয়টিকে গেরুয়া শিবিরের মাস্টার স্ট্রোক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। উল্লেখ্য বরাবরই বিজেপি উচ্চবর্ণের দল বলে পরিচিত। মুখে একথা স্বীকার না করলেও এতদিন ধরে উচ্চবর্ণের ভোট ব্যাপক হরে তারা পেয়ে আসছে। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির বড় অংশের সমর্থনও পেয়েছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশ, সর্বত্র সেটা দেখা গিয়েছিল।

বিষয়টি নিয়ে গেরুয়া শিবির মনে করছে উচ্চবর্ণের ‘কমিটেড’ ভোট তাদের পক্ষেই থাকবে। সেখানে যদি দলিত, অনগ্রসর আদিবাসী সমাজের ভোট গতবারের মতো এবারও বেশি হারে পাওয়া যায় তাহলে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে জিততে সামান্যতম অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তাদের। মূলত সেই অঙ্কেই দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করেছে বিজেপি। আর দেরিতে হলেও সেটা বুঝতে পেরেছেন বলেই আদিবাসী সমাজকে বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছেন মমতা। দ্রৌপদীকে সমর্থন না করার অর্থই হল আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যাওয়া। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে মমতার উপর অসন্তুষ্ট আদিবাসী সমাজের একটা বড় অংশ। অন্তত বিরোধীদের দাবি তেমনটাই। তবে শুধু এই দাবি নয়, বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ‘সেটিং’ রয়েছে। তাই বিজেপির চিত্রনাট্য মেনে কার্যত দ্রৌপদীকে সমর্থনের বার্তা শুক্রবার দিয়েছেন মমতা।

স্বাভাবিকভাবেই মমতার এই মনোভাবে অসন্তুষ্ট বিরোধী জোট।  বাস্তব হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিশ্চিত জয় পাচ্ছেন দ্রৌপদী মুর্মু। কিন্তু যশবন্ত ভাল লড়াই দিতে পারলে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধীরা বাড়তি অক্সিজেন পেতেন। কিন্তু সেই লড়াইয়ের ক্ষেত্র কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছেন মমতা। এ যেন খেলার আগেই খেলা শেষ। উল্লেখ্য পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে বারোটি আসন সংরক্ষিত রয়েছে তফশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য। আর উত্তরবঙ্গের আটটি লোকসভা আসনের মধ্যে তিনটি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গেও মুখ থুবড়ে পড়ে তৃণমূল। সব মিলিয়ে তৃণমূল এখন মনে করছে আদিবাসী তথা পিছিয়ে পড়া সমাজকে একটা বার্তা দেওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। তাই দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে তৃণমূলের। কিন্তু রাজনীতির কারবারিদের একাংশ যথারীতি বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের সমালোচনা করতে শুরু করেছে। তাঁদের ব্যাখ্যা, দ্রৌপদী মুর্মু এনডিএ জোটের প্রার্থী এটা জানার পরেও তখন কেন তৃণমূল তাঁকে সমর্থনের রাস্তায় হাঁটল না? তাঁদের কটাক্ষ চাপে পড়ে এখন ডিগবাজি খেতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। সব মিলিয়ে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী জোট আদৌ কতটা হওয়া সম্ভব সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন খোদ মমতাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − twelve =