নিজস্ব প্রতিনিধি: বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় যেভাবে দলেরই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তা নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। আর তার মধ্যেই দলের অস্বস্তি আরও বাড়ালেন অন্য এক তাপস। তিনি রাজারহাট-নিউটাউন বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়। তাঁরই এলাকার ইকোপার্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়া সম্মিলনীতে আমন্ত্রণ পাননি তিনি। আর সেই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাপস। আক্ষেপ করে সংবাদ মাধ্যমে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, “দলে বাবু ও চাকরের মধ্যে আমরা বোধহয় সেকেন্ডটার মধ্যে পড়ি!”
সেই সঙ্গে নাম না করলেও তাঁর নিশানায় যে রয়েছেন তৃণমূল নেতা তথা বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্ত, সেটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। যেভাবে বিজেপিতে গিয়ে আবার তৃণমূলে ফিরে এসে দলে ভালভাবে স্থান করে নিয়েছেন সব্যসাচী, তাতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ তাপস চট্টোপাধ্যায়। তাই তাপসের প্রশ্ন, নিউটাউনে দলের বা কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে কেন তিনি ব্রাত্য হয়ে যান? আর সেই সঙ্গেই বিস্ফোরক ভঙ্গিতে নিজের ক্ষোভ জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, দলে দুটি শ্রেণি, বাবু ও চাকর। চাকরেরা ডাক পান না। ২০২১-এর নির্বাচনে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগাল করেছিলেন, তাঁরা আমন্ত্রিত থাকেন। অর্থাৎ তাপসের নিশানায় যে সব্যসাচী রয়েছেন, সেটা স্পষ্ট। তিনি বলেন, “নিজের বিধানসভা এলাকায় হলেও বিজয়া সম্মিলনী সম্পর্কে কিছু জানি না। এটা গত বছরেও হয়েছিল। তখন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখনও কোনও সদর্থক উত্তর পাইনি। আমন্ত্রণ না পাওয়ায় লজ্জিত, মানুষের কাছে মিথ্যে বলে চোখ ঢাকতে হয়। মনে হয় মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি জানেন না, মুখ্যমন্ত্রীকে বলার সুযোগ নেই।’’ এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। ক্ষোভের সঙ্গে আরও বলেন, “যাঁরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে, আমি কি তাঁদের মধ্যেও পড়ি না? আমি বোধহয় দুষ্টু, না হলে আমার চান্স হয় না কেন? আমরা দলের পরিশ্রমী কর্মী বলেই হয়ত আমন্ত্রণ পাই না। দলে বাবু ও চাকরের মধ্যে আমরা বোধহয় দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। হয়ত ভাল গান গাইতে পারি না, বা নাচতেও পারি না, তাই আমন্ত্রণ মেলে না। হয়ত নেত্রীকে ভাল গালিগালাজ করতে পারি না, তাই ডাক পাই না। যাঁরা ২০২১-এ বলেছেন বেগম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁরা আমন্ত্রিত থাকেন। যাঁরা বলেছিলেন আর তো মাত্র কটা দিন, তাঁরা আমন্ত্রণ পান। জানি না আমন্ত্রণ পেতে গেলে দেখতে সুন্দর হতে হয় কিনা! দিনরাত পরিশ্রম করা অপরাধ কিনা জানি না। আমার ধারণা আমার কর্মকাণ্ড চাপা দেওয়ার জন্য কেউ একজন চক্রান্ত করছেন। সুযোগ হলে দিদিকে বলব যে, শুধু একজনকে চাইলে হয় না। যাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করে, তাঁদেরও মূল্যায়ন করুন।’’ এর পাশাপাশি আক্ষেপ করে বলেন, “আমি সিপিএম থেকে এসেছি বলে হয়ত, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন আছে। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে আমাকে প্রমাণ করতে হবে।’’
খোদ মুখ্যমন্ত্রীই বিজেপিতে চলে যাওয়া সব্যসাচী দত্তকে আবার ঘরে ফিরিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি খুশি করেনি তাপস চট্টোপাধ্যায়কে। যদিও কখনই তিনি দলবিরোধী একটি কথাও বলেননি। কিন্তু এবার বিজয়া সম্মিলনীতে আমন্ত্রণ না পেয়ে আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি। সম্প্রতি বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় প্রকাশ্যে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেছেন। সুদীপ বিজেপির সঙ্গে কার্যত ‘অ্যাডজাস্ট’ করে চলছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাপস রায়।কিন্তু বৃহস্পতিবার দেখা গিয়েছে আলিপুরের ‘উত্তীর্ণ’ সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে যে বিজয়া সম্মিলনী হয়েছে, সেখানে মমতার পাশেই ছিলেন সুদীপ ও নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন তাপস রায়। তবে কি সুদীপ ইস্যুতে দল কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের সাংসদের পাশেই রয়েছে? এই চর্চা যথারীতি শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে।
স্বাভাবিকভাবেই বিষয়গুলি নিয়ে তৃণমূলে অন্দর থেকে দু’রকমের মত উঠে আসছে। দলের একাংশ দুই তাপসের মন্তব্যকে সমর্থন করছেন। আবার অপর অংশ বলছেন নেত্রী সবটাই নজরে রাখছেন। প্রয়োজন মনে করলে তিনি যা করার করবেন। তবে রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়ার পর আবার পুরনো দলে ফিরে এসে অনেকেই বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, যারা দীর্ঘদিন তৃণমূলকে চরম আক্রমণ করেছেন কুরুচিপূর্ণ ভাষায়, তাঁরাও তৃণমূলে এসে সম্মান বা পদ পাচ্ছেন। যেমন বাবুল সুপ্রিয়। দিনের পর দিন তৃণমূলকে নজিরবিহীন ভাষায় আক্রমণ করার পর জোড়াফুল শিবিরে এসে বিধায়ক ও মন্ত্রী হয়েছেন। বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাস বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হয়ে আবার তৃণমূলে ফিরে এসে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়েছেন। সব্যসাচী দত্ত বিজেপিতে গিয়ে নির্বাচনে হারের পর ফের তৃণমূলে এসে দলে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। একই ভাবে মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি ঘুরে আবার পুরনো দলে ফিরে এসেছেন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ বৈঠক করেছেন বলে সূত্রের খবর। সেই সঙ্গে জানা গিয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিশেষ দায়িত্ব পেতে পারেন মুকুল। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি ঘুরে তৃণমূলে আসার পর ত্রিপুরায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। বিজেপির টিকিটে জিতে আসা রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী তৃণমূলে এসে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে গিয়েছেন। একটা সময় বাম শিবির থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়ে রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন পরেশচন্দ্র অধিকারী। সেখানে তাপস চট্টোপাধ্যায় সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসার পর আর দল ছাড়েননি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইকোপার্কের বিজয়া সম্মিলনীতে আমন্ত্রণ না পেয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দলে তিনি উপেক্ষিত, এটাই বারবার বোঝাতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কীভাবে সামলাবেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটাই দেখার।