নিজস্ব প্রতিনিধি: গত বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যেকটি আসনে তৃণমূল জয় পেলেও তাদের দিক থেকে শুধুমাত্র মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভাঙড় কেন্দ্রটি। জেলার একমাত্র এই কেন্দ্রেই তৃণমূল হেরে গিয়েছিল। সেখানে জয় পেয়েছে আইএসএফ। আর তখন থেকেই বারবার নতুন করে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে ভাঙড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এখন প্রশ্ন কেন বারবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভাঙড় বা আশপাশের অঞ্চল? আসলে জমি মাফিয়াদের নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল, তৃণমূলের মধ্যে ব্যাপক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যত দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে, নিত্যনতুন অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে সেগুলিকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটের ব্যবসা কাদের হাতে থাকবে সেই নিয়ে গণ্ডগোল, এলাকার রাজনৈতিক রাশ তৃণমূলের কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে সেই নিয়ে নিত্য ঝামেলা, মূলত এইসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই সারা বছর ভাঙড় জুড়ে অশান্তি ঘটতে দেখা যায়। আর সেই সূত্রেই গত বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে হারতে হয়েছে তৃণমূলকে। তৃণমূলের ঘোষিত প্রার্থী রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে কখনও প্রকাশ্যে বা কখনও পিছন থেকে তৃণমূলেরই একটি অংশ কাজ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। মূলত অভিযোগের তির উঠেছিল ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলামের দিকে। তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়নি বলে আরাবুলের অনুগামীরা তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
ভাঙড়ের আনাচে-কানাচে কান পাতলে একটা কথাই শোনা যায় সেখানে নানা ক্ষেত্র থেকে টাকা লুট করার জন্য সকলেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকতে চান। যা নিয়ে তিতিবিরক্ত সেখানকার মানুষজন। ভাঙড়ের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। মূলত চাষবাস, মৎস্য চাষ, নির্মাণ শিল্পে কাজ, ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ ইত্যাদিতে যুক্ত থাকেন এখানকার মানুষ। যারা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। আর দিনের পর দিন এলাকা দখলকে ঘিরে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল যেভাবে সামনে এসেছে, তার জন্যই গত বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা আইএসএফকে বেছে নিয়েছিলেন। গত বছরের শেষের দিকে একটি ঘটনার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায় তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল কোন পর্যায়ে যেতে পারে। গভীর রাতে ফজলে করিম নামে এক তৃণমূল নেতার বাড়ি ঘিরে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। কোনও রকমে খাটের নিচে লুকিয়ে প্রাণে বাঁচেন করিম। এরপরেই তিনি হামলার অভিযোগ করেন তাঁর বিরোধী শিবিরের নেতা কাইজার আমেদের বিরুদ্ধে। গোটা ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে দলের সর্বোচ্চ স্তরে বিচার চেয়ে আবেদন করেন তিনি। যদিও তাঁর সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন কাইজার ও তাঁর অনুগামীরা। তাই এই সমস্ত ঘটনার বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন ভাঙড়ের মানুষ।
শুধু সাম্প্রতিক সময় বলে নয়, ভাঙড়ের ৫০ বছরের ইতিহাস বলছে এখানকার মানুষ সব সময় স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটেছেন। ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ২৮০টি আসনে ভোট হয়েছিল। যার মধ্যে ২১৬টিতে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। সেখানে সিপিএম পেয়েছিল মাত্র ১৪টি আসন। অভিযোগ ওঠে কংগ্রেস এতটাই রিগিং করেছিল বিরোধীরা কোথাও লড়তে পারেনি। তবে সেই কংগ্রেস ঝড়ের মধ্যেও ব্যতিক্রমী ফল হয়েছিল ভাঙড়ে। সেখানে সিপিএম প্রার্থী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা জয়ী হয়েছিলেন। আবার ২০০৬ সালে ২৩৫টি আসনে জিতে ফের ক্ষমতায় এসেছিল সিপিএম তথা বামফ্রন্ট। তৃণমূলের আসন সংখ্যা নেমে আসে ২৯ এ। কংগ্রেসের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। কিন্তু সেই বছর রাজ্য জুড়ে লালঝান্ডা স্বমহিমায় উড়লেও ভাঙড়ে হেরে গিয়েছিল সিপিএম। জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী আরাবুল ইসলাম।
একইভাবে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে। তৃণমূল সুনামিতে মুছে গিয়েছে সিপিএম তথা বামেরা। চতুর্দিকে শুধুই সবুজ ঝড় চলতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেবারেও উল্টোপথে হেঁটেছে ভাঙড়। সিপিএমের বাদল জমাদার হারিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী আরাবুল ইসলামকে। একইভাবে গত বিধানসভা নির্বাচনে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় তৃণমূলের ঝড় চললেও ভাঙড়ে হেরে যেতে হয়েছিল শাসক দলকে। এই পরিসংখ্যানেই এটা স্পষ্ট যে ভাঙড়ের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বরাবরই প্রতিবাদী ভূমিকা রয়েছে। তাই তাঁদের উপর জোর খাটিয়ে কিছু করা যাবে না। আর সেই কারণেই এখন ভাঙড়ের মানুষ তৃণমূলের চরম বিরোধী হয়ে উঠেছেন। পাওয়ার গ্রিড আন্দোলনে ভাঙড়ের মানুষ কীভাবে যোগ দিয়েছিলেন সেকথা সকলেই জানেন। তৃণমূল শত চেষ্টা করেও তাদের বশে আনতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভাঙড়-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তৃণমূল সেখানে অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। এলাকার তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ এখন চুটিয়ে আইএসএফ করছেন। তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দিচ্ছেন তাঁরা। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাঙড় তথা বিস্তীর্ণ অঞ্চল কাদের দখলে থাকে এখন সেটাই দেখার।