পটনা: একটা ছোট্ট প্রশ্ন, বাবা কী করেন? ভিতর থেকে নিঃস্ব করে দিত প্রাচীকে৷ একটা সময় পদে পদে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত তাঁকে৷ যত এড়াতে চাইতেন, তত বেশি করে শুনতে হত৷ যা একেবারেই ভালো লাগত না তাঁর৷
আরও পড়ুন- সুপ্রিম নির্দেশে মুক্তি পাচ্ছেন রাজীব গান্ধীর ছ’জন হত্যাকারীই! তালিকায় নলিনীও
স্কুলে বন্ধুরা যখন গর্ব করে বলতেন আমার বাবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার কিংবা কলেজের প্রফেসার-তখন মাথা নীচু করে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন প্রাচী৷ একটা সময় লজ্জা পেতেন বাবার পেশা নিয়ে কথা বলতে৷
তাঁর বন্ধুরা যখন তাঁদের বাবাকে নিয়ে গর্বিত, তখন প্রাচীর লজ্জা হত৷ কারণ, ওঁর বাবা কোনও অফিসার নন, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও নন৷ সামান্য পানের দোকান তাঁর! ছিল না বড় গাড়ি৷ পোশাক আশাক অত্যন্ত সাটাদামা৷ নেই মোটা অঙ্কের বেতন৷ তাই সকলের সামনে মুখ ফুটে বাবার কথা বলতে পারতেন না তিনি৷
বিহারের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ওই তরুণীর পুরো নাম প্রাচী ঠাকুর। সম্প্রতি তাঁর ছোটবেলার কাহিনী সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন তিনি৷ জানিয়েছেন, কেন বাবার পেশার কথা উঠলেই এড়িয়ে যেতেন ৷ এ প্রসঙ্গে অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর৷
প্রশ্নটা প্রথম করেছিল স্কুলের বন্ধুরা৷ জানতে চেয়েছিল- তোর বাবা কী করে? পানের দোকান চালায়? তাঁর বাবার পেশা নিয়ে বন্ধুরা বহু বার খোঁচাও দিয়েছে। প্রাচী তখন অনেক ছোট৷ বন্ধুদের এই সব কথায় বুক ফেঁটে কান্না আসত তাঁর৷ প্রাচী বলেন, “এক দিন দাদার এক বন্ধু সবার সামনে বাবার পেশা নিয়ে কথা বলেছিল। সে দিন বাবার উপরেই আমার রাগ হয়েছিল৷ লজ্জা হচ্ছিল, বাবা এমন একটা পেশার সঙ্গে জড়িত।”
প্রাচীর মনে সাধ ছিল, তাঁর বাবাও অন্যদের বাবার মতো বড় কোনও কাজ করবে। নিজের একটা বড় দোকান কিংবা কোনও অফিসের কর্মী হবেন। একটা ভাল সাইকেল থাকবে তাঁর। ভালো জামা কাপড় পড়বেন৷ বাবা ভালো মাইনে পেলে, তা দিয়ে নতুন নতুন বই কিনবেন৷ কিন্তু সেই ইচ্ছা অধরাই থেকে গিয়েছিল প্রাচীর।
স্বপ্নগুলো যখন এলোমেলো হয়ে যেত, তখন খুব রাগ হত৷ কিন্তু পরে বুঝতে পারেন, তিনি কতটা ভুল ছিলেন৷ প্রাচী মনে প্রাণে চান, তাঁর বাবা যেমন ছিল, যেমন আছে, তেমনই থাক। এটাই তাঁর গর্ব৷
বিহারের মতো রাজ্যে যেখানে গ্রামে-গঞ্জে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, দশমের গণ্ডি পেরতেই শুরু হয় পাত্রের খোঁজ, সেখানে দাঁড়িয়ে প্রাচীর বাবা ছিলেন ভিন্ন পথের পথিক। প্রাচী বলেন, ‘‘বিয়ে করার জন্য বাবা আমাকে কোনও দিনই চাপ দেননি। বরং সব সময় বলেছেন, তোকে আরও বেশি করে পড়তে হবে। অনেক দূর এগোতে হবে।’’
সে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে আজও সন্ধ্যা নামলে মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখা বারণ৷ কিন্তু প্রাচীকে কোনও দিনও ঘরে আটকে রাখেননি তাঁর বাবা৷ বরং নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পাঠাতেন৷ সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেও তাঁর পায়ে শিকল পরিয়ে দেননি৷ প্রাচী বলেন, “যেখানে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, মেয়েদের নম্র হতে হয়, নিচু স্বরে কথা বলতে হয়, সেখানে বাবা আমাকে শিখিয়েছেন কী ভাবে আত্মবিশ্বাস অর্জন করে দৃপ্ত কণ্ঠে কথা বলতে হয়। কী ভাবে মঞ্চে পারফর্ম করে দর্শকদের মন জয় করতে হয়।’’
যে মুলুকে মেয়েদের পড়ার নিয়ে কেউ গুরুত্ব দেন না, সেই মুলুকের মেয়েকে সুদূর পুদুচেরীতে পড়তে পাঠিয়েছিলেন সেই পান বিক্রেতা বাবা৷ যাঁকে নিয়ে তাঁর এত লজ্জা ছিল৷
প্রাচী জানান, তাঁর বাবা তাঁকে জিমেও পাঠিয়েছেন৷ কখনও ঘরে বসিয়ে রাখেননি৷ যখন সকলে তাঁকে প্রশ্ন করে তাঁর আত্মবিশ্বাসের রহস্য কী? তখন তিনি অকপটে বলেন, আমার বাবা৷ জোড় গলায় বলেন, বাবাই আমার অনুপ্রেরণা৷
তাঁর কথায়, “এটা ঠিক, একটা সময় বাবার পেশা নিয়ে লজ্জা পেতাম। কিন্তু আজ ওঁর জন্য গর্ববোধ করি। ওঁর মেয়ে হতে পেরে গর্ব হয়। না, বাবা বদলায়নি। একই রকম আছে। তবে পেশাও বদলায়নি। সেই পানের দোকান আছে। পাশাপাশি, তিনি রান্নার গ্যাস সারাইয়ের কাজ করেন।”
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>