কলকাতা: তথাকথিত প্রথাগত এবং পুঁথিগত শিক্ষা ছিল না তাঁর৷ কিন্তু, মেধায় কোনও খামতি ছিল না৷ তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম সফল বিজ্ঞানী। তিনি ‘ভারতের এডিসন’ এবং ‘কোয়ম্বত্তূরের সম্পদ সৃষ্টিকর্তা’ হিসাবেই অধিক পরিচিত। তাঁর নাম গোপালস্বামী দোরাইস্বামী নাইডু ওরফে জিডি নাইডু। দেশে শিল্প বিপ্লব শুরু করার ক্ষেত্রেও যার কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
ভারতীয় উদ্ভাবক এবং ইঞ্জিনিয়র গোপালস্বামী ছিলেন ভারতে প্রথম বৈদ্যুতিক মোটরের আবিষ্কারক৷ তবে শুধু এটুকুউ নয়, আরও কয়েকটি আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গোপালস্বামীর নাম। শিল্পক্ষেত্র ছাড়া কৃষি (হাইব্রিড চাষ) এবং অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কোনও দিনও ভুলবে না দেশ৷
দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি ছাড়াও কেরোসিন চালিত পাখা, প্রজেকশন টিভি, যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর, বৈদ্যুতিক রেজার এবং টিকিট কাটার মেশিন আবিষ্কার করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন গোপালস্বামী৷
১৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ তামিলনাড়ুর কোয়ম্বাটুরের কলঙ্গায় তেলুগু কৃষক পরিবারে জন্ম গোপালস্বামীর। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁৎ মায়ের মৃত্যু হয়। ছোটবেলায় স্কুলে যেতে একেবারেই পসন্দ করতেন না গোপালস্বামী। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকদের উত্ত্যক্ত করেই মজা পেতেন৷ এর জন্য তাঁকে বহু বার শাস্তিও পেতে হয়েছে। তবে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন ভারতের এডিসন৷
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে হাত লাগান গোপালস্বামী ৷ তখন তাঁর ১৬ বছর বয়স হবে৷ এক ব্রিটিশ আধিকারিকের কাছে রুজ মোটরবাইক দেখেন তিনি৷ যা তাঁকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু সেই সময় মোটরবাইক কেনার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। কিন্তু মোটরবাইকের নেশা চেপে যায় তাঁর৷ সেই নেশাতেই গ্রাম ছেড়ে কোয়ম্বাটুরে চলে আসেন গোপালস্বামী। লক্ষ্য ছিল, প্রচুর টাকা উপার্জন করে সাধের বাইক কেনা। কোয়াম্বাটুরে টানা তিন বছর ধরে একটি হোটেলে কাজ করেন তিনি৷ তাতে একটি মোটরবাইক কেনার মতো অর্থ সঞ্চয় করে ফেলেন গোপালস্বামী তার পর আবার বাড়ি ফিরে যান।
এর পর তিনি ওই ব্রিটিশ আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ৩০০ টাকার বিনিময়ে তাঁর কাছ থেকে ওই রুজ মোটরবাইকটি কিনে নেন। কিন্তু, মোটরবাইক চেপে ঘোরার বদলে ইঞ্জিনের নকশা এবং গঠন খতিয়ে দেখতে তিনি সেটিকে খুলে ফেলেন। সেটি ছিল গোপালস্বামীর মোটর ইঞ্জিন বোঝার প্রথম প্রচেষ্টা।
মোটরবাইকের গঠন এবং সজ্জা ভাল ভাবে বুঝে নিয়ে এক জন মেকানিক হিসাবে কাজ শুরু করেন গোপালস্বামী। কোয়াম্বাটুরে একটি ছোট গ্যারেজও খুলে ফেলেন৷ তবে এখানেই থেমে থাকেননি তিনি৷ ১৯২০ সালে ‘ইউনিভার্সাল মোটর সার্ভিসেস’ নামে একটি পরিবহণ সংস্থা শুরু করেন এই বিজ্ঞানী৷ একটি চারচাকা গাড়ি কিনে তার সাহায্যে পোলাচি থেকে পালানি পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ শুরু করে দেয় তাঁর সংস্থা।
কয়েক বছরের মধ্যেই গোপালস্বামী সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন৷ তাঁর মালিকানাধীন সংস্থা তৎকালীন ভারতে সবচেয়ে বড় যাত্রী পরিবহণ সংস্থায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে তিনি কোয়াম্বাটুরের পিলামেদুতে ‘ন্যাশনাল ইলেকট্রিক ওয়ার্কস’ নামে আরও একটি নতুন সংস্থা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে ডি বালাসুন্দরম নাইডুর সহযোগিতায় নিজের হাতে তৈরি করে ফেলেন ভারতে প্রথম বৈদ্যুতিক মোটর৷ এর পর আরও কিছু সংস্থা খুলেছিলেন তিনি৷ বৈদ্যুতিক মোটরের সাফল্যে বালাসুন্দরামের সঙ্গে ‘টেক্সটুল’ এবং ‘লক্ষ্মী মেশিন ওয়ার্কস’ও তৈরি করেন।
ভারতে দাড়ি কাটার প্রথম আধুনিক বৈদ্যুতিন যন্ত্র গোপালস্বামীরই সৃষ্টি। যার নাম দিয়েছিলেন ‘হেইলব্রন’। এ ছাড়াও দাড়ি কাটার জন্য অতি পাতলা ব্লেড, ক্যামেরার বেশ কয়েকটি যন্ত্র, ফলের রস বার করার মেশিন, ভোটিং মেশিন এবং কেরোসিন চালিত পাখাও তাঁরই আবিষ্কার৷ ১৯৪১ সালে একটি আধুনিক রোডিয়ো আবিষ্কার করেছিলেন গোপালস্বামী।
১৯৫২ সালে একটি দুই আসন বিশিষ্ট পেট্রলচালিত গাড়ি তৈরি করেন গোপালস্বামী৷ সেই গাড়ি সাধারণের হাতে পৌঁছে দিতে দাম রাখেন মাত্র ২০০০ টাকা৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকার তাঁকে প্রয়োজনীয় অনুমোদনপত্র (লাইসেন্স) দিতে অস্বীকার করে।
এক জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ী ছাড়াও, চিত্রগ্রাহক হিসাবেও গোপালস্বামীর নাম ইতিহাসের পাতা লেখা থাকবে। দেশে-বিদেশে ভ্রমণের শখ থাকা গোপালস্বামী একাধিক নামীদামি ব্যক্তিত্বের ছবি লেন্স বন্দি করেছিলেন৷ তবে ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে সমস্ত ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি৷ দায়িত্ব দেন পুত্র-কন্যাদের হাতে৷ শিক্ষামূলক কাজে নিজের বাকি জীবন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি ৮০ বছর বয়সে মারা যান ‘ভারতের এডিসন’ গোপালস্বামী।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>