অনশনের ছ’দিন: ফুটপাতে পড়ে থাকা ১৮ শিক্ষকের মৃত্যুর দায় নেবে তো সরকার?

কলকাতা: সালটা ১৮৫৭৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঘটেছিল সিপাহী বিদ্রোহ৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বন্দুক উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেছিল কয়েক হাজার সেনা৷ ভারতীয় ইতিহাসে সেই প্রথম লেখা হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা৷ সেই শুরু প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াই৷ এই মুহূর্তে সেই লড়াই-আন্দোলনের বিস্তর পরিবর্তন ঘটলেও বদল ঘটেনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার লম্বা

অনশনের ছ’দিন: ফুটপাতে পড়ে থাকা ১৮ শিক্ষকের মৃত্যুর দায় নেবে তো সরকার?

কলকাতা: সালটা ১৮৫৭৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঘটেছিল সিপাহী বিদ্রোহ৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বন্দুক উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেছিল কয়েক হাজার সেনা৷ ভারতীয় ইতিহাসে সেই প্রথম লেখা হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা৷ সেই শুরু প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াই৷ এই মুহূর্তে সেই লড়াই-আন্দোলনের বিস্তর পরিবর্তন ঘটলেও বদল ঘটেনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার লম্বা ইতিহাস৷ শাসকের বদল হলেও শোষণ থামেনি৷ বরং ব্রিটিশের পরিবর্তে এবার সরকারের বিরুদ্ধে জমতে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আজ বঙ্গদেশে জন্ম দিয়েছে ‘শিক্ষক বিদ্রোহে’র পরিস্থিতি! যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি ও অনৈতিক বদলি রুখতে দীর্ঘ ‘শিক্ষক বিদ্রোহ’ আজ পৌঁছে গিয়েছে আমরণ অনশনে৷ টানা এক সপ্তাহ ধরে রাজপথ আগলে ধর্নায় কয়েক হাজার শিক্ষক৷ দীর্ঘ ছ’দিন ধরে ফুটপাতে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন ১৮ জন প্রাথমিক৷ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বৃষ্টি, তীব্র গরমের জেরে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক৷ কিন্তু, তেতেও কুছ পরোয়া নেই রাজ্যের৷

উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স এসোসিয়েশনের ডাকে বাংলার সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সমাবেশে চলছে বিকাশ ভবনের অদূরে৷ কিন্তু, শিক্ষকদের অবস্থান বিক্ষোভ এক সপ্তাহ কেটে যেতে চলেও এখনও দেখা মেলেনি শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের৷ উল্টে শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন কড়া হুঁশিয়ারি৷ তবে, সরকারি হুমকি উপেক্ষা করে আজও অনড় অনশনরত শিক্ষকরা৷ ইতিমধ্যেই শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সমাজের বুদ্ধিজীবী মহল৷ অনশনকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ৷ লিখেছেন, ন্যায্য দাবি নিয়েই সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মৌখিল প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করতে চাননি বা পারেননি সরকারপক্ষ৷ এটা দুর্ভাগ্যের যে অন্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকরা কম বেতন পান৷ সেই সমস্যার সুরাহা না হওয়াতেই আজ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তাঁরা৷ চোখের সামনে এ রাজ্যে এমনটা হচ্ছে এটা লজ্জার৷ গত পাঁচদিন (এখন ৬ দিন) ধরে অনশন করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ ১৮ জন ইতিমধ্যেই আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ এসব দেখেটাও বড় অসহায় ব্যাপার৷ তবে এটাই আশা যে আগামী দিনে হয়তো সরকারপক্ষ এই সমস্যার সমাধান করবেন৷

অনশনের ছ’দিন: ফুটপাতে পড়ে থাকা ১৮ শিক্ষকের মৃত্যুর দায় নেবে তো সরকার?
অসুস্থ অনশনকারী শিক্ষক অরুণ কুমার দাস৷ দেবাশিষ বর্মন নামের আরও এক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷

কিন্তু, এতকিছুর পরও নিরুত্তাপ প্রশাসন৷ উল্টে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘শিক্ষকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক৷’ কিন্তু শুভবুদ্ধির উদয় হাওয়ার বার্তা দিলেও আর কতদিন পর মিটবে শিক্ষকদের সমস্যা? আর কতদিন রাজপথে পড়ে থাকতে হবে শিক্ষকদের? আর কত শিক্ষক অসুস্থ হওয়ার পর ঘুম ভাঙবে শিক্ষকদের? ১৮ অশনকারীর মৃত্যু পর কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সাত দিনের ধর্না ও ছ’দিনের অনশন চালিয়ে যাচ্ছি৷ ১৮ জন শিক্ষক অনশন করছেন৷ শিক্ষকদের দাবি না মিটলে এই ১৮ জন শিক্ষকের মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে৷’’

শিক্ষকদের এই আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রথমিক শিক্ষক রাজ বর্মা বলেন, ‘‘উস্থি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা এখানে অনশনে বসেছি৷ আমাদের ন্যায্য অধিকার ও আমাদের ১৪ জন সহকর্মীর অনৈতিক বদলির বিরুদ্ধে৷  আমাদের দাবি দুটি৷ প্রথমত প্রাথমিকে সর্বভারতীয় বেতনক্রম চালু অর্থাৎ PB4  যার গ্রেড পে হবে ৪২০০ টাকা৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের যে ১৪ জন সহকর্মীকে অনৈতিকভাবে ৪০০-৬০০ কিমি দুরে বদলি করা হয়েছে, তাঁদের আগের স্কুলে ফিরিয়ে আনা৷ অনশনের ৬ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পথে৷  তবুও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷ এমনকি জল, টয়লেটেরও ব্যবস্থা করা হয়নি প্রশাসনের৷ একটা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের অনশন চালিয়ে যাচ্ছি৷ আমাদের দাবি যতদিন মেনে হবে না ততদিন আমরা আমাদের অনশন চালিয়ে যাব৷’’

যোগ্যতা বাড়লেও বাড়েনি বেতন৷ ঝুলে মহার্ঘ ভাতা মামলা৷ বাড়ানো হয়েছে ষষ্ঠ বেতন বেতন কমিশনের মেয়াদ৷ বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে পুলিশি তাণ্ডবের শিকার হতে হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের বড় অংশকে৷ যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি ও বদলির নির্দেশের বিরুদ্ধে চলছে সাত দিনের ধর্না ও ছ’দিনের অনশন৷

কিন্তু কেন এই সমস্যা? জানা গিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন৷ রাজ্য সরকারের সেই সময়কার নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক৷ পরে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেতে গেলে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হতেই হবে৷ থাকতে হবে দু’বছরের শিক্ষণ প্রশিক্ষণ৷ ২০১২-য় রাজ্য এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করে৷ কিন্তু নিয়ম মেনে যোগ্যতা বাড়লেও পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত ৯৩০০ থেকে ৩৪৮০০ টাকা বেতনহার তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না৷ আর এরই প্রতিবাদে বারংবার রাজপথে নামেন কয়েক হাজার শিক্ষক৷ এবার রাজপথে আগলে অধিকারের দাবিতে ফুটপাতে পড়ে রয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষক৷ কবে মিটবে এই সমস্যা? স্কুল ছেড়ে কেন রাস্তায় পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা? উঠছে প্রশ্ন৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − 7 =