আঙ্কারা: ভয়াল ভূমকম্পে ছারখার তুরস্ক। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পেল্লাই বাড়িগুলি৷ ধ্বংসস্তুপের নীচ থেকে এখনও ভেসে আসছে আর্তনাদ৷ দিনরাত এক করে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা৷ তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, প্রাথমিক ভাবে যা মনে করা হয়েছিল, তার আট গুণ বাড়তে পারে প্রাণহানি। সে ক্ষেত্রে ১৯৯৯-এর বিপর্যয়কেও হার মানাবে ২০২৩৷ ১৯৯৯ সালে উত্তর আনাতোলিয়া চ্যুতিতে এমনই এক ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮০০০, কোনও হিসাব নেই আহতের! ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত দুই দেশের পাশে ভারত
সোমবার ভোরে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়৷ ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল দক্ষিণ তুরস্কের গাজিয়ানতেপ প্রদেশের পূর্ব দিকে নুরদাগি শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে। রিখটার স্কেলের কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। প্রথম কম্পনের ১১ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বার কম্পন অনুভূত হয় লেবানন, সিরিয়া এবং সাইপ্রাসের বিভিন্ন অংশে। ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানাচ্ছে, রিখটার স্কেলে এই কম্পনের তীব্রতা ছিল ৬.৭। এর পর থেকে বারেবারে কেঁপে উঠেছে তুরস্ক এবং সিরিয়া। গত কাল সিরিয়া সীমান্তের কাছে তুরস্কের দক্ষিণ প্রান্তে পরপর তিনটি ভূমিকম্প হয়৷ যা কার্যত এই অঞ্চলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে৷ রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮, ৭.৬ এবং ৬.০৷ কিন্তু কেন তুরস্কের ভূমিকম্প এত ভয়াবহ ছিল?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র কম্পন শক্তির কারণেই এতো বেশি ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। যখন তুরস্কের মাটি কেঁপে ওঠে, তখন ভোর৷ অধিকাংশ মানুষই ছিলেন ঘুমের ঘোরে। ফলে তাঁরা বেরিয়ে আসার সুযোগ পাননি৷ তাছাড়া বাড়িগুলির দৃঢ়তাও একটি বিষয়। পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলকানো অ্যান্ড রিস্ক কমিউনিকেশন বিভাগের রিডার ড. কারমেন সোলানা বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ তুরস্ক এবং বিশেষ করে সিরিয়ার অবকাঠামোগুলি খুব একটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী ছিল না। তাই মাটি কাঁপতেই সেগুলি ভেঙে পড়ে৷’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানো নির্ভর করবে উদ্ধার তৎপরতার উপরেই। জীবিতদের উদ্ধারে প্রথম ২৪ ঘন্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ৪৮ ঘণ্টা পর জীবিত মানুষের সংখ্যা অনেকটাই কমে যায়।”
এই ভূমিকম্পের কারণ কী?
পৃথিবীর মহাদেশ ও মহাসাগরীয় তলে কতগুলি অনমনীয় এবং কঠিন খণ্ড আপেক্ষিকভাবে গুরুমণ্ডলের অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের উপর চলমান৷ এই খণ্ডগুলিকে সাধারণ ভাবে পাত বা প্লেট বলা হয়, যা একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে।
এই প্লেটগুলি প্রায়শই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে থাকা অন্য আরেকটি প্লেটের সঙ্গে ঘর্ষণের মাধ্যমে এই নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়। তবে চাপ অতিরিক্ত বাড়লে কখনো কখনো একটি প্লেট অপর প্লেটের উপর উঠে পড়ে৷ তখনই ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরে যায়।
প্লেটগুলোর এ ধরণের ঘর্ষণের কারণে অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮২২ সালের ১৩ই অগাস্ট একটি ভূমিকম্প হয়েছিল৷ রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৭.৪৷ তবে এটি সোমবারের ভূমিকম্পের তুলনায় বেশ কম। তা সত্ত্বেও, উনিশ শতকের ভূমিকম্পের ফলে শহরগুলির প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল, শুধু আলেপ্পো শহরেই সাত হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভূমিকম্পের আফটারশক প্রায় এক বছর ধরে চলেছিল৷ সোমবারের ভূমিকম্পের পরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি আফটারশক হয়েছে৷ ভূ-বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এবারও এই অঞ্চলে হওয়া পূর্ববর্তী ভূমিকম্পের মতোই হবে।
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থানই এই দেশটিকে ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলেছে। তুরস্কের মূল অবস্থান আনাতোলিয়ান টেকটনিক প্লেটের উপর। এছাড়াও তুরস্ক আরও দুটি মহাদেশীয় টেকটনিক প্লেটের উপরে অবস্থান করছে। সেই প্লেট দুটি হল– ইউরেশিয়ান ও আফ্রিকান টেকটনিক প্লেট। এছাড়া আরও একটি প্লেট এই অংশে এসে সংযুক্ত হয়েছে। সেটি হলো অ্যারাবিয়ান প্লেট। চার চারটি ছটফটে টেকটনিক প্লেটের উপরে অবস্থানের কারণেই তুরস্কের নীচে থাকে ভূগর্ভ বারবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। যার প্রভাবে এখানে বারবার ভূমিকম্প হয়েছে৷ এইসব প্লেটের কোনও একটির সামান্য নড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হবে। আর সেটাই হচ্ছে।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>