কেউ চাকরি ছেড়েছেন, কেউ ভুলেছেন বিলেতি চমক! মহিলা ব্রিগেডের শাসনে উন্নয়নের পথে বহু পঞ্চায়েত

কেউ চাকরি ছেড়েছেন, কেউ ভুলেছেন বিলেতি চমক! মহিলা ব্রিগেডের শাসনে উন্নয়নের পথে বহু পঞ্চায়েত

2b062131d070a9f9e61cbea82332989b

কলকাতা:  যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে বন্দিত হয়ে এসেছে নারী শক্তি৷ নারীরা পারে না এমন জিনিস বোধহয় নেই৷ জেদ-অধ্যাবসা, আত্মবিশ্বাস আর একাগ্রতায় ভর করে এ বিশ্বসংসার জয় করেছে তাঁরা৷ বৃহত্তর স্বার্থের জন্য কোনও কিছু ত্যাগ করতেও তাঁরা পিছপা হন না৷ কখনও দেশরক্ষায়, কখনও আবার সমাজের কাজে  নিজেদের ব্রতী করেছেন এই নারীরা৷ এমনই কিছু নারীর কথা বলা যাক৷ 

তাঁদের সকলেরই বয়স ৩০-এর কোঠায়৷  কেউ বিলেত ফেরত, কেউ আবার দেশেই বড় চাকরি ছেড়ে নাড়ির টানে ফিরেছেন নিজের গ্রামে। সমাজ বদলের আশায় তাঁরা বেছে নিয়েছেন গ্রাম পঞ্চায়েতকে। খোলনলচে বদলে নিয়ে এসেছেন শাসনের নতুন ধারণায়। চেনেন সেই নারীদের? এঁরা হলেন দেশের মহিলা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। যাঁদের হাত ধরে এক নতুন পথে এগিয়ে চলেছে পঞ্চায়েত শাসন।

ছবি রাজাওয়াত। বছর ৩৬-এর ছবি রাজস্থানের সোডা গ্রামের প্রধান। দেশের মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও উজ্জ্বল মুখ তিনিই। দেশের অন্যতম বড় টেলি যোগাযোগ সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরি করতেন ছবি৷ কিন্তু সেই চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামে৷ 

২০১০ সালে সোডার পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হন৷ তার পরই বদলে যায় গ্রামের ভোল৷ প্রযুক্তিতে চৌখস ছবি গ্রামে একে একে নিয়ে আসে সৌরবিদ্যুৎ, স্বচ্ছ পানীয় জল, পাকা শৌচাগার৷ তৈরি করেন পাকা রাস্তা৷ চালু করেন ব্যাঙ্ক-সহ বহু পরিষেবা৷ রাজস্থানের গ্রামগুলির বদলে যাওয়া চালচিত্রের কুশীলব তিনিই৷ সেই কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর ঝুলিতেই৷ ২০১১ সালে গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত দারিদ্র সংক্রান্ত আলোচনা সভাতেও বক্তৃতাও করেন রাজস্থানের এই পঞ্চায়েত প্রধান।

দেশের কনিষ্ঠতম পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য নাম হল শাহনাজ খান। মাত্র ২৪ বছর বয়সে হরিয়ানার গরহাজান গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন এই তরুণী। তখন তিনি ডাক্তারি পড়ুয়া। সবে মাত্র এমবিবিএস শেষ করে পরবর্তী পড়াশোনা শুরু করেছেন৷ শহনাজের আগে কোনও মহিলা গ্রামপ্রধান তো দূর, এত শিক্ষিত কেউ পঞ্চায়েত প্রধান হননি হরিয়ানার ওই এলাকায়। ২০১৮ সালে তাঁকেই নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নেন গ্রামবাসীরা।

পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পেয়েই সবার আগে শাহনাজ গুরুত্ব দেন গ্রামের পরিচ্ছন্নতার উপর। শিশু এবং মহিলাদের জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশের উপর জোর দেন৷ সেই সঙ্গে শুরু হয় গ্রামের  মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ৷ 

সুষমা ভাদু। বছর ৩২-এর এই তরুণীও হরিয়ানার একটি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। নিস্তরঙ্গ গ্রাম্যজীবনে বিপ্লব আনেন তিনি।

হরিয়ানার ধানি মিয়া খান গ্রামের নিয়ম ছিল, মেয়েরা বিয়ের পর মাথা থেকে কাপড় সরাতে পারেন না না। লম্বা ঘোমটা ঝুলবে নাক পর্যন্ত। তিন সন্তানের মা সুষমা পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরই বাড়িতে জানিয়ে দেন তিনি ঘোমটা দিতে পারবেন না। কারণ ঘোমটা টেনে পঞ্চায়েতের কাজ করা সম্ভব নয়। ঠিক তার পরের সপ্তাহেই তিনি পঞ্চায়েতের বৈঠক ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোমটা টানা নিষিদ্ধ করেন। 

তবে সুষমা বাকিদের মতো উচ্চশিক্ষিত নন। ক্লাস সেভেনই স্কুলছুট হন৷ কিন্তু তিনিই মেয়েদের পর্দামুক্তি ঘটানোর কারিগড় হয়ে ওঠেন৷ এ ছাড়াও গ্রামের সার্বিক পরিচ্ছন্নতা, পুরুষ-নারীর সংখ্যার অনুপাত, স্কুলছুটের সংখ্যা কমিয়ে পুরষ্কৃত হয় তাঁর পঞ্চায়েত।

একদা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার ছিলেন আরতি দেবী। সেই চাকরিকে আলবিদা জানিয়ে দায়িত্ব নেন গ্রাম পঞ্চায়েতের৷ তিনি ওড়িশার ধুনকাপাড়ার পঞ্চায়েত প্রধান। 

পঞ্চায়েতের দায়িত্ব নিয়েই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের জন্য শুরু হয় তাঁর কাজ৷ প্রচারে আসে ওড়িশার এই এলাকার কারুশিল্প। গ্রামের মানুষ যাতে সরকারের সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করেন আরতি৷  তাঁর কাজ আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি পায়। তাঁর কথা শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় আমেরিকার দূতাবাস থেকে৷

আটরাম পদ্মা বাই। তেলঙ্গানার একটি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান তিনি৷ ওই গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্বাহ করেন চাষবাস করে। অথচ ২০১৩ সালে পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পাওয়ার পর পদ্মা দেখেন, হতদরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে কুড়ুল, কাটারি-সহ চাষবাসের অন্যান্য জরুরি সামগ্রী কেনার টাকাটুকুও নেই।

সবার আগে ৩০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে প্রথমেই চাষবাষের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে ফেলেন পদ্মা। তার পর প্রতি দিন নামমাত্র ভাড়ায় সেই সব সরঞ্জাম ব্যবহার করতে দেন গ্রামের গরীব চাষীদের৷ এতে কাজ আসতে শুরু করে গ্রামের মানুষের হাতেও৷ 

পদ্মা তাঁর পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা তিন গ্রামেই ঢালাই করা রাস্তা বানিয়েছেন। গ্রামের স্কুলে স্বচ্ছ পানীয় জলের ব্যবস্থাও করেছেন।

ভক্তি শর্মা। বছর ২৮-এর এই তরুণী মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের প্রান্তে বারখেড়ি আবদুল্লা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান । রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার পর আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। টেক্সাসে মোটা বেতনের চাকরির প্রস্তাবও ছিল তাঁর কাছে৷ কিন্তু ফিরে আসেন মাটির টানে৷ 
 

বারখেন্ডি গ্রামের মেয়ে ভক্তি পঞ্চায়েতের নির্বাচনে নিজের গ্রামে ভোটে দাঁড়ান এবং জিতেও যান। পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ার পর গ্রামগুলির জন্য সরকারের যা যা প্রকল্প এবং সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা। তার গ্রাম মডেল গ্রাম পঞ্চায়েত হয়ে উঠবে বলেই আশা ভক্তির।
 

 

রাধা দেবী। রাজস্থানের ভারসিয়া গ্রামের প্রধান। নিজে ক্লাস ফাইভে স্কুলছুট হন৷  কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি জোর দেন গ্রামের শিক্ষার উপরেই। তাঁর চেষ্টায় আজ রাজস্থানের এই গ্রামে শিক্ষার হার উর্ধ্বমুখী। এর কৃতিত্ব পঞ্চায়েত প্রধান রাধাকেই দিয়েছে প্রশাসন।
 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *