দুর্গতিহারিনী ডেকে এনেছিল দুর্যোগ, মহালয়ার পূর্ণলগ্নে বাঙালি মননে পড়েছিল কোপ

সেবছর শোনা যায়নি বীরেন বাবুর কণ্ঠ। মহালয়ার সকালে মহানায়ক উত্তম কুমারের কণ্ঠে নতুন ভাবে প্রচারিত হয় চণ্ডীপাঠ। শুরু হয় বিতর্ক। কলকাতা শহরে সেদিন মহালয়া শুভ ছিল না। একাধিক বাঙালি ভেঙে দিয়েছিল রেডিও। তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল শহর জুড়ে। মহানায়কের সম্মানহানী ঘটতেও পারত। কিন্তু তা সামলে নিয়েছিল রেডিও কর্তৃপক্ষ। যদিও উত্তম বাবু কোনও দিনই মন থেকে চাননি, বীরেন বাবুর বদলে মহালয়ার সকালে তাঁর কণ্ঠ শোনা যাক।

মহালয়া – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র – দেবী মহামায়া – বাঙালির প্রাণের পুজো। ঠিক এই ক্রমেই চলে আসছে বছরের পর বছর। এই ধারার শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। এবছর যদিও করোনা ভাইরাসের গ্রাসে সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত। নেই সেই দুর্গা পুজোর আমেজ। তবুও আসন্ন মহালয়ার ভোরে বাঙালি জেগে উঠবে। এটাই কাম্য। কারণ মহালয়ার ভোরে রেডিও চালিয়ে শিউলির গন্ধের সঙ্গে বীরেন বাবুর কণ্ঠ বাঙালিকে এক অন্য মাত্রা দেয়। এ যেন হাজার বছরের আবেগ। যত দুঃখ, যত কষ্ট, যত যন্ত্রণাই থাক না কেন মহালয়ার ওই স্তোত্রপাঠ দেবী চণ্ডী'কে জাগানোর সঙ্গেই বাঙালিকেও জাগিয়ে তোলে।

১৯৬৬ সাল বলায় অনেকেই ভাববেন এই তথ্য ভুল। কিন্তু আজকে যে রেকর্ড করা মহিষাসুরমর্দিনী আমরা শুনি তা শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সাল থেকেই। তার আগে ১৯৩১ সাল থেকে লাইভ গাওয়া হত মহিষাসুরমর্দিনী, যা সরাসরি সম্প্রচারিত হত অল ইন্ডিয়া রেডিও'য়ে। আজ ৮৯ বছর পরেও এই অনুষ্ঠানের বাঙালির এক অদ্ভুত টান জড়িয়ে আছে। যদিও মাঝে একবার এই আবেগে বাধা পড়েছিল।

শিল্পী তাঁর সৃষ্টি কর্মকে বার বার পরিমার্জন করে থাকে, যা সত্যিই কাম্য। তাই সেই শিল্পের পরিবর্তিত বা তত্ব কথায় 'আপডেটেড ভার্সান' আসবে একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেভাবে আবেগ জড়িয়ে যায়, যা আর কখনওই পরিবর্তন করা যায় না। তেমনই এক উদাহরণ আমাদের 'মহিষাসুরমর্দিনী'। যেহেতু এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে একটা গোটা সম্প্রদায়ের আবেগ জড়িয়ে আছে তাই তাতে কোনও পরিবর্তন আনা যে ঝুঁকি পূর্ণ হবে তা বুঝেছিলেন সম্প্রচারকরা। কিন্তু সব কিছুরই যখন পরিমার্জন সম্ভব তখন এক্ষেত্রেও একবার চেষ্টা করা যায়, এমনটাই  ভেবেছিলেন এআইআর কর্তৃপক্ষ।

মহালয়া ছবির দৃশ্যে যিশু সেনগুপ্ত

সেবছর শোনা যায়নি বীরেন বাবুর কণ্ঠ। মহালয়ার সকালে মহানায়ক উত্তম কুমারের কণ্ঠে নতুন ভাবে প্রচারিত হয় চণ্ডীপাঠ। শুরু হয় বিতর্ক। কলকাতা শহরে সেদিন মহালয়া শুভ ছিল না। একাধিক বাঙালি ভেঙে দিয়েছিল রেডিও। তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল শহর জুড়ে। মহানায়কের সম্মানহানী ঘটতেও পারত। কিন্তু তা সামলে নিয়েছিল রেডিও কর্তৃপক্ষ। যদিও উত্তম বাবু কোনও দিনই মন থেকে চাননি, বীরেন বাবুর বদলে মহালয়ার সকালে তাঁর কণ্ঠ শোনা যাক। রূপালি পর্দায় যদি উত্তম কুমার বাঙালির মনের মানুষ হন, তাহলে মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বাঙালির শ্বাস-প্রশ্বাস। সেকথা জানতেন অরুণ চট্টোপাধ্যায়ও। অরুণ বলার অর্থ সেই সময় মহানায়ক নয়, বরং অরুণ হিসাবেই ক্ষমা চেয়েছিলেন বীরেন্দ্র বাবুর কাছে। পাশাপাশি রেডিও কর্তৃপক্ষ টের পেয়েছিলেন এই আবেগকে কোনও দিন পরিবর্তন করা যাবে না।

মহালয়া

অবশেষে ভুল স্বীকার করে সেবছর ষষ্ঠীর দিন ফের মহিষাসুরমর্দিনী' সম্প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল রেডিও কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই আঘাত সহ্য করতে পারেননি বীরেন বাবু। ক্রমেই এরপর শয্যাশায়ী হন তিনি। গত বছর এই বিষয়ে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। নাম মহালয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন শুভাশিষ মুখোপাধ্যায় এবং উত্তম কুমারের চরিত্রে ছিলেন যিশু সেনগুপ্ত। একটি বিশেষ ভুমিকায় ছিলেন প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন সৌমিক সেন। ছবিটি দেখলেই বোঝা যায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' এর পরিবর্তে 'দুর্গা দুর্গতিহারিনী' কি দুর্গতিই না ডেকে এনেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 1 =