স্থাপত্যবিদ, শিল্পী নাকি বিশ্বস্রষ্টা, কোন নামে ডাকা যায় দেবতা বিশ্বকর্মাকে! ঋকবেদ অনুযায়ী বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বকর্মাই, কিন্তু পুরাণে তাঁকে দেবশিল্পী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের ১৩৩কোটি দেবতা এবং তাঁদের অবস্থান নিয়ে নানা মুণির নানা মত। সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে বিশ্বকর্মা সৃষ্টির দেবতা।
একজন শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য বিশারদ বিশ্বকর্মা একাধিক স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন, যেমন কুবেরের অলকাপুরী, লঙ্কার প্রাসাদ, কৃষ্ণের দ্বারকাপুরী ইত্যাদি। এই সমস্ত স্থাপত্য যা কিনা জগত শ্রেষ্ঠ অলংকার ও ভূষণ প্রস্তুতকারক বিশ্বকর্মার হাতেই তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি স্বর্গলোকের স্রষ্টাও হলেন তিনি। তৎকালীন আধুনিক শহর হস্তিনাপুর ও ইন্দ্রপ্রস্থ এর রূপরেখা গড়েন সেই বিশ্বকর্মাই। পাশাপাশি বর্তমান সভ্যতার জনক কিন্তু তিনিই, মৎস পুরাণ অনুযায়ী, কূপ ও জলাশয় খনন, প্রতিমা নির্মাণ, বাড়ি ও বাগানের পরিকল্পনা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই বিশ্বকর্মার হাত ধরে শুরু হয়েছিল। আমরা জানি বেহুলার বাসর ঘরও তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
নানা রকম ভাবে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার জন্ম বর্ণনা করা হয়েছে। সেই নিয়ে আছে অদ্ভুত সমস্ত কাহিনী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার জন্ম। ভবিষ্যপুরাণ মতে, অষ্টবসুর অন্যতম প্রবাসের ঔরসে এবং বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনীর গর্ভে বিশ্বকর্মার জন্ম। স্কন্দপুরাণ মতে, বিশ্বকর্মার পাঁচটি মুখ ও দশটি হাত। পদ্মপুরাণ অনুসারে দৈত্যশিল্পী ময় বিশ্বকর্মার পুত্র আবার বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে শিল্পী ত্বষ্টাও বিশ্বকর্মার পুত্র।
বর্তমানে হাতির সামনে দাঁরিয়ে থাকা বিশ্বকর্মার যে মূর্তি আমরা দেখি, সেই মূর্তির আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক হলেন হরষিত কেশরী রায়। হরষিত কেশরী রায় কর্মকার সম্প্রদায়ের প্রবক্তা ছিলেন। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় তিনি বিশ্বকর্মার পুজো করেন সর্বপ্রথম। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সৃষ্টি কৃতি ছিল অসাধারণ। বিশ্বকর্মার রূপলোকের একাধিক স্থাপত্যকীর্তি জগতের শোভা বাড়াত। তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একাধিক শিল্পীর স্রষ্টাও। শোনা যায় বিশ্বকর্মার হাত ধরেই বানর কুল সেতু গড়তে শিখেছিল। যখন রামচন্দ্র লঙ্কা অভিযানে যাচ্ছিলেন, তখন সমুদ্রগর্ভে যে বিশাল সেতু নির্মাণের প্রয়োজন হয়েছিল, সেই সেতু নির্মাণে বিশ্বকর্মার অবদান অনস্বীকার্য।
সকল দেবতার চেয়ে বিশ্বকর্মা অনন্য। দেবতাদের বিলাসিতা দেখা যায়নি তাঁর মধ্যে কোনও সময়। বিশ্বকর্মা পুজোও তাই অনন্য। হিন্দুশাস্ত্র মতে সকল দেবদেবীর আরাধনা তিথি অনুযায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বকর্মার ক্ষেত্রে তা হয় সূর্যের স্থান পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন অর্থাৎ ভাদ্র-সংক্রান্তির দিন সূর্য সিংহ লগ্ন থেকে কন্যা লগ্নে প্রবেশ করে। বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মকালের শেষে যে সূর্য মেঘ রচনা করেন, বর্ষণের মাধ্যমে কৃষিকর্ম সংরক্ষণ করেন আদতে তিনিই বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা আসলে সূর্যের এক বিশেষ রূপ। বিশ্বকর্মা কৃষিরও দেবতা, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন অনেক জায়গায় 'রান্নাপুজো'র চল রয়েছে।