কলকাতা: একজন মহানায়ক, আর অন্যজন বিশ্ববন্দিত পরিচালক। সত্যজিৎ-উত্তম জুটির ছবিগুলো খানিকটা সেই কারণেই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে প্রথম উত্তম কুমারকে দেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন অবশ্য তিনি চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেননি। এরপর পরিচালনার গুনে দেখেন 'বসু পরিবার' এবং 'চাপাডাঙ্গার বউ'। এর ১০-১২ বছর পর উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ করেন সত্যজিৎ রায়। ছবির নাম 'নায়ক'। ততদিনে অবশ্য উত্তম কুমার একটা ব্র্যান্ড। সত্যজিৎ রায়ের নামও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
বলা হয় উত্তম কুমারকে মধ্যমণি করেই 'নায়ক'-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। উত্তম কুমার ততদিনে রোমান্টিকতার শীর্ষে উঠে গিয়েছেন। সুচিত্রা সেন হোক বা সুপ্রিয়া দেবী, তাঁর সঙ্গে যে কোনও নায়িকার কেমিস্ট্রি দর্শক সাদরে গ্রহণ করছে। এর মধ্যে 'নায়ক' একেবারে অন্যরকম একটি ছবি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি মানেই আর পাঁচটা বাংলা ছবি থেকে একটু আলাদা। একটু ভিন্ন। নাটকীয়তার এখানে তেমন একটা আনাগোনা নেই। 'নায়ক'-ও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যখন উত্তম কুমারের 'নায়ক' নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল তখন সত্যজিৎ রায় সরাসরি বলেছিলেন যে, উত্তম কুমার যে সমস্ত প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করে অভ্যস্ত, 'নায়ক' কিন্তু সেরকম নয়। এখানে প্রেমের একটি চোরাস্রোত অবশ্যই রয়েছে। সেখানে রোমান্টিক স্পর্শ তেমন নেই। 'নায়ক' এক মধ্যবিত্ত ঘরের অভিনয় পাগল যুবকের গল্প যে অভিনয় জগতে এসে তরতর করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছায়। কিন্তু তার মন ঠিক-ভুল, ভাল-মন্দের মধ্যে দোদুল্যমান। সেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেকে নিয়েই এগিয়েছে 'নায়ক'-এর গল্প।
একেই ছবির পরিচালক সত্যজিৎ। তার উপর 'নায়ক'-এর মত চিত্রনাট্য। না করেননি উত্তম। রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। শোনা যায় ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকার কারণেই 'নায়ক' হতে রাজি হয়েছেন উত্তম কুমার। না করতে পারেননি। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সাবধান করেছিলেন উত্তমকে যে তিনি যে ধরনের ছবিতে অভিনয় করতে অভ্যস্ত এমন ছবি কিন্তু এটি নয়। এখানে নায়কের গুণের পাশাপাশি দোষও দেখানো হয়েছে। এমনকি তাঁকে অত্যন্ত হালকা মেকআপ করতে হবে। কখনও কখনও মেকআপ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ফলে উত্তমের গালে যে পানবসন্তের দাগগুলো রয়েছে, সেগুলোও ক্যামেরায় বোঝা যাবে। কিন্তু নিজের লুক নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিলেন না উত্তম কুমার। 'নায়ক'-এর মত চিত্রনাট্যের কোন ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাননি তিনি।
আরও পড়ুন: সপ্তপদী'র ওথেলোর চরিত্রচিত্রণে হোঁচট খেয়েছিলেন উত্তম কুমার, আসরে নামেন উৎপল
একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে উত্তম কুমারের প্রয়াণ এরপর সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ করে তিনি তৃপ্তি পেয়েছিলেন। ২৫ বছরের পরিচালনার জীবনে খুব একটা বেশি সেইরকম তৃপ্তি তিনি পাননি। উত্তম কুমার ছিলেন প্রফেশনাল। তাঁর অভিনয় দক্ষতা সহজাত ছিল। কখনও কখনও নির্দেশের বাইরে গিয়ে অভিনয় করতেন উত্তম কুমার। কিন্তু তা কখনও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছতো না। 'নায়ক' ছবির পর উত্তম কুমার ও সত্যজিৎ রায় আরও একটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। ছবির নাম 'চিড়িয়াখানা'। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। এখানে সত্যজিতের গোয়েন্দা ছিলেন উত্তম। এই ছবিটিও ছিল সম্পূর্ণ নায়িকা বর্জিত ছবি। ফলে উত্তম কুমারের পক্ষে ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এতোদিন দর্শক রোমান্টিক নায়ক হিসেবে এসেছে গ্রহণ করে এসেছে। তাঁর পর্দার উপস্থিতি হাজার হাজার তরুণীর মনে হিল্লোল তুলেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নায়িকা বর্জিত 'চিড়িয়াখানা' ছবিতেও উত্তম কুমার সফল। নিজের অভিনয়গুণে চশমা আঁটা বাঙালি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ রূপে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন মানুষের মনে।