শ্যামলেশ ঘোষ: “আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়…”। প্রিয় শহরকে চিরবিদায় জানিয়ে জন্মভূমিতে ফিরে যাচ্ছেন ডাক্তার জ্যাক। এ মাসের মাঝামাঝি ৮৮-র জ্যাক ফিরছেন নিজদেশ ইংল্যান্ডে। সেখানেই জীবনের শেষবেলাটুকু কাটানোর ইচ্ছে তাঁর।
পুরো নাম জ্যাক প্রেগার। পিছিয়েপড়া অভাবি মানুষের ত্রাতা, আর্তজনের সহায় ডাক্তার জ্যাককে অনেকে মাদার টেরেসার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। বছর-চল্লিশেক আগে পা রাখেন কলকাতায়। তারও আগে ছিলেন বাংলাদেশে এবং নানা অপবাদ দিয়ে সেদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে রাখেননি বেশিদিন। তাঁকে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে যে! কলকাতায় এসেই সম্বলহীন জ্যাক ডাক্তারি-ব্যাগ হাতে নেমে পড়েন পথে। মিডলটন রো-এ খোলা আকাশের নিচে ১৪ বছর ধরে চালিয়েছেন “ফুটপাথ ক্লিনিক”। সেখানে হতদরিদ্র মানুষকে নিখরচায় সুচিকিৎসা আর প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র যোগানের পাশাপাশি ক্রমে ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে, হাভাতে শিশুদের পোশাক-আশাক দিয়ে, শিক্ষার আলো দেখিয়ে, হাতেকলমে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়ে এবং জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে হয়ে উঠলেন প্রকৃত দোসর। সম্ভবত কোনওদিন জ্যাক সাহেবের আত্মত্যাগ ভুলতে পারবে না আনন্দনগরী। কিছুদিন কাজ করেছেন মাদার টেরেসার সঙ্গেও। ১৯৯৩-এ স্বীকৃতি পায় নিজের সংস্থা “ক্যালকাটা রেসকিউ”। সংস্থার হেল্থ ক্লিনিকে মানুষ বিনামূল্যে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, এডস প্রভৃতি অসুখে চিকিৎসা ও পরামর্শ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে সংস্থাটি একাধিক স্কুল, হ্যান্ডিক্রাফট এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। কয়েক লক্ষ গরিব-দুস্থ মানুষ সেই সব পরিষেবা পেয়েছেন। জ্যাক সাহেব বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে চিকিৎসা করেছেন, সেবা করেছেন আর তাদের কাছে শর্তও রেখেছেন, যাতে পরিবারের তরুণ প্রজন্মকে তারা স্কুলে পাঠান। তাঁকে নিয়ে “ডক্টর জ্যাক” (ব্লুমসবারি, লন্ডন, ১৯৯১) নামে একটি বই লিখেছেন জেরেমি জোসেফ। ডেভিস রিস প্রযোজিত “ডক্টর জ্যাক” তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পরিচালক বেনোয়া লঞ্জ। জন্মসূত্রে ইংরেজ হলেও ২০১৭-তে পেয়েছেন “সেরা এশীয়” সম্মান।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
নিতান্ত সাধারণ ঘরের ছেলে। জন্ম ১৯৩০-এর ২৫ জুলাই ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করে আটবছর ওয়েলস-এর নিজস্ব খামারে চাষবাস করেছেন। ইতিমধ্যে তৃতীয়-বিশ্ব নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পরিকল্পনা, দক্ষিণ বা মধ্য আমেরিকার দরিদ্র মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। সেই লক্ষ্যে স্প্যানিশ ভাষাও শিখে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। অর্থনীতি দিয়ে কাজ হবে না, বুঝতে পেরে পরিণত বয়সে এসে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। ডাবলিনের রয়েল কলেজ অব সার্জেন্স থেকে যখন ডিগ্রি পেলেন, তখন বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। ১৯৭২। সবেমাত্র ইন্টার্নশিপ শেষ করেছেন। খবর পেলেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের সাহায্যের জন্য ডাক্তার দরকার। সিদ্ধান্ত বদলে কনসার্ন-এর হয়ে চলে এলেন বাংলাদেশে। অনেকে তাঁকে বাংলাদেশে আসতে মানা করেছিলেন। নিজের ভাইও সতর্ক করলেন, পৃথিবীর যেকোনও দেশে যাওয়ার খরচ দেবেন, শুধু তিনি যেন বাংলাদেশে না যান। কিন্তু সেকথা কানে তুললেন না জ্যাক। উদ্বাস্তু সংকট-দীর্ণ বাংলাদেশে দিনরাত অক্লান্তভাবে মানুষের সেবাকর্ম চালিয়ে যেতে লাগলেন। শিখলেন বাংলা এবং উর্দু। বস্তিতে বস্তিতে নিরন্ন নিরাশ্রয় কর্মহীন মানুষ, বিশেষত শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে পরের বছর বাধ্য হলেন দেশে ফিরতে। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই ফিরে এলেন বাংলাদেশে। এবার নেদারল্যান্ডসের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তেরে দে হামে-র হয়ে। নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি ৯০ শয্যার একটি শিশু হাসপাতাল তৈরি করতে শুরু করলেন। হাসপাতাল চালানোর খরচ সংগ্রহ করলেন আমেরিকার মিনিয়াপোলিসের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে। তাঁর কাজে মুগ্ধ বাংলাদেশ সরকার পরিত্যক্ত অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার আবেদন জানায়। জমিও দেয়। মাত্র কুড়িজন শিশু-বালক নিয়ে চালু হয় সেই অনাথ আশ্রম। ক্রমে জ্যাক টের পান, আশ্রয় কেন্দ্রের আড়ালে বাংলাদেশি শিশুরা পাচার হয়ে যাচ্ছে, প্রধানত ইওরোপে। এমনকী তাদের অশ্লীল ছবিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। জ্যাক নীরব থাকতে পারলেন না। প্রতিবাদ করলেন এবং পাচার বন্ধের জন্য সোচ্চার হলেন। কিন্তু জ্যাক জানতেন না, পাচারকারীদের হাত অনেক লম্বা। তারা জ্যাককেই শিশুপাচারকারী, ইহুদি চর ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সপরিবারে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা করল। ১৯৭৯-এ দেশছাড়া করে ছাড়ল তাঁকে। সেই ঘটনা আশীর্বাদ হয়ে উঠল কলকাতা শহরের। পায়ে পায়ে ৪০ বছর ধরে শহরের সর্বহারাদের ভাল থাকা আর ভালবাসার স্বপ্ন ফেরি করলেন জ্যাক প্রেগার।
ইতিমধ্যে দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছে। এখন অশীতিপর জ্যাকের অন্যতম ভরসা সংস্থার চিফ এগজিকিউটিভ জয়দীপ চক্রবর্তী এবং গোটা ম্যানেজমেন্ট টিম। তিনি চলে যাওয়ার পরও মানুষ যাতে সংস্থার পাশে থাকেন, সেই আবেদন রেখেছেন প্রবীণ জ্যাক। বলেছেন, “ক্যালকাটা রেসকিউ গড়ে ওঠার পেছনে সংস্থার কর্মীদের বিপুল অবদান রয়েছে। তাদের অনেকেই কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় এই সংস্থায় বিনিয়োগ করেছেন। আমি আশাবাদী, অসহায় মানুষের প্রতি মমতা ও শ্রদ্ধার ধারা বজায় রাখবেন সকলেই। যে বাচ্চারা এখান থেকে শিক্ষালাভ করেছে, যে মানুষেরা চিকিৎসায় উপকৃত হয়েছেন বা সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন, প্রত্যেকেই চিরকাল প্রতিষ্ঠানকে ভালবেসে যাবেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংস্থা দীর্ঘজীবী হবে।” প্রত্যয়ী ডাক্তার জ্যাক দু’চোখে হাত বুলিয়ে নেন। বিদায়বেলায় চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল কি?