কিংকর অধিকারী: তৃতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বই ‘পাতাবাহার’। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬২ । ‘গাছেরা কেন চলাফেরা করে না’ শীর্ষক প্রচলিত গল্পে যে কথাগুলি রয়েছে সেগুলি হুবহু এরকম —
অনেক অনেক বছর আগেকার কথা একসময় পৃথিবীতে গাছেরাও চলাফেরা করতে পারত। শেকড়বাকড় মাটির নিচে চালাচালি করে দিব্যি তারা ঘুরে বেড়াত।
তখন পৃথিবী ছিল অনেক সবুজ, অনেক সুন্দর। সে সময় গাছ ও মানুষ ছিল দুজনের বন্ধু। তারা একে অপরের উপকারী সাথী বলেই মনে করত। কোনো যানবাহন ছিল না। মানুষকে হেঁটে হেঁটেই দূর-দূরান্তরে যেতে হতো। হাত-বাকসো নিয়ে যাওয়া ছিল এক কঠিন ব্যাপার। গাছেরাই তখন সে-দায়িত্ব পালন করত। তাদের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিত চারদিকে। মানুষ তাদের পোশাক-আশাক বাকসো-প্যাটরা, থলি সেখানে ঝুলিয়ে রাখত।
এমনকি মানুষ চাইলে তার জিনিস তার গ্রামে পৌঁছে দেবার কাজও করত এইসব উপকারী গাছেরা। ঠিকমতো গাছের ডালে জিনিস রেখে তাদের নির্দেশ দিলেই গাছ হেঁটে গিয়ে সেই জিনিসপত্র ঠিক ঠিক লোকের বাড়িতে পৌঁছে দিত।
এমন কি বুড়ো লোকের উপকারেও আসত গাছেরা। তার জন্য বুড়ো লোককে গাছের ডালে চড়তে হতো। তারপর গাছেরাই তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিত। এমন কি সে যেখানে যেতে চায় সেখানেও তাকে পৌঁছে দিত। কি সুন্দর ছিল সেসব দিন!
এমন আশ্চর্য ভ্রমণ কে অার কবে দেখেছে? তোমরাও দেখোনি।
একবার একদল লোক জঙ্গলে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর প্রত্যেকেই ভীষণ ক্লান্ত। চলবার শক্তিটুকু আর নেই। তখনই ঠিক করল কাঁধে রাখা বোঝার ওজন কমাতে গাছের ডালে জিনিসপত্র রেখে দেবে। সেই মতো তাদের ভারী জিনিসপত্র তারা গাছের বিভিন্ন ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে নিজেরা হেঁটে চলল। কিন্তু এত ওজন গাছের ডাল সহ্য করতে পারল না। ডাল গুলি সব কাত হয়ে ঝুঁকে পরল নীচে। মানুষেরা তা দেখে সহানুভূতি দূরে থাক, হো হো করে হেসে উঠল। এর আগে তারা কোনদিন গাছকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখেনি। করুণার বদলে তাদের মুখে কুৎসিত হাসি ফুটে উঠল। এমন কি সকলে মিলে আনন্দে হাততালি দিল। এমন উপহাস গাছেদের সহ্য হলো না। তারাও অপমানিত বোধ করল। তখনই ঠিক করল, অনেক হয়েছে, আর তারা চলাফেরা করবে না।
তারপর থেকে ভ্রমণের সময় মানুষের জিনিসপত্র ভারী হলেও মানুষকেই বইতে হয়। গাছ আর চলাফেরা করে না বলেই মানুষের সঙ্গে সহযোগিতা করে না। তবু গাছেরা আজও কত উপকারী। ফুল, ফল মানুষকে উপহার দেয়। মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন যোগান দেয় নিয়মিত। মানুষকে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচায়। নদীর পাড়ে ভাঙ্গন থেকে মানুষকে বাঁচায়। গাছ গাছালি দিয়ে কত ওষুধ তৈরি হয়। কত পাখি গাছে বাসা বাঁধে।
গাছেদের দুঃখ একটাই, তারা এখন আর চলাফেরা করে না। কেন চলাফেরা করে না, আশা করি, তা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।
এই হচ্ছে পুরো গল্পের বিষয়। পাঠ্য বইতে এটিকে প্রচলিত গল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ এমন গল্প আগে কোনো দিন শুনেছি বলে মনে হয়নি। ভালো করে পড়ে দেখেছি এই লেখাটিকে গল্পের মধ্যে ফেলা যায় বলে মনে হলো না। এমন ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে যেন একটি ইনফরমেশন দেয়া হয়েছে এই লেখাটির মধ্য দিয়ে। এই বঙ্গে জনপ্রিয় বহু প্রচলিত গল্প রয়েছে কিন্তু শিশু পাঠ্য হিসেবে সরকারি সিলেবাসে কেন এই লেখাটিকে স্থান দেয়া হলো তা বিস্ময়ের!
বাজারে বহু ভূত-প্রেত, রাক্ষস খোক্ষস বা আজগুবি নানান গল্পের বই রয়েছে। কেউ চাইলে বাজার থেকে এমন ধরনের বহু গল্প সংগ্রহ করে আলাদা ভাবে পড়তেই পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা শ্রেণিতে সরকারিভাবে সিলেবাসে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তার সিলেবাস নির্ধারণ করতে হয় – যা ছোটদের যথার্থ বিকাশে সহায়তা করে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ঈশপের গল্প,পঞ্চতন্ত্রের গল্প ইত্যাদি এসবকিছু তাহলে শিশুরা পড়বেনা? উত্তরে বলি, পড়বে, হাজার বার পড়বে। কিন্তু এই গল্পটার মধ্যে সেরকম কোন কল্পনা বা শিশু শিক্ষার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে কি? শিক্ষার সিলেবাসে কয়েকটি মাত্র প্রবন্ধ বা গল্প বা কবিতা থাকে। তাই এগুলি নির্বাচন করার সময় অত্যন্ত উপযোগী বিষয়গুলি বাছতে হয়। ধরুন, পাতাবাহার বইটির পাঠ্যসূচিতে যদি ৫ টি গল্প রাখার পরিকল্পনা করা হয় তাহলে কি শিশু পাঠের উপযোগী সেরা ৫ টি গল্পের তালিকায় উক্ত গল্পটি স্থান পাওয়া উচিত? কি মনে হয়? ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প, বা শিশুদের উপযোগী বহু গল্প রয়েছে যেগুলি পড়লে সত্যিই কিছু নীতি শিক্ষার বিষয়ে শিশুদের মনে ছাপ ফেলে। এই গল্পটি পড়লে শিশুদের মনে কি কোনো কল্পনা শক্তির বিকাশ বা তাদের মনের উপযোগী শিক্ষা পাবে?
এই গল্পটি পড়ার পর যদি ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করা হয় যে, আগেকার দিনে গাছ কি চলাফেরা করত? তার উত্তর যদি তারা ‘হ্যাঁ’ লেখে তাহলে তার উত্তরটিকে কেটে দেওয়া যাবে কি? গল্পের বিষয় অনুযায়ী আমরা তা কেটে দিতে পারি না। তাহলে পাঠ্যসূচির মধ্যে এমন একটা গল্প যা শিশুমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে তেমন গল্প অন্তর্ভুক্ত হবে কেন? শিশুদের উপযোগী কি অন্য কোন গল্প ছিল না?
আমরা তো ছোটদের উপযোগী অনেক গল্প পড়েছি। সেখানে বহু বিষয় যেমন গাছ, পাখি, বাঘ, সিংহ, শেয়াল ইত্যাদির চরিত্র দিয়ে এমন সুন্দর ভাবে কিছু গল্পের উপস্থাপনা রয়েছে সেটা কোন সময়ই আজগুবি মনে হয়নি। বরং সেখানে এক একটি চরিত্র-এর মাধ্যমে আসলে মানুষের চরিত্রকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যেখান থেকে পাঠক তার মনের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং জীবনে গ্রহণ করার মত বেশ কিছু মূল্যবান শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীর এই পাঠ্যবই পাতাবাহারে যে গল্পটি রয়েছে সেটি পড়লে ছোটদের মনে যে প্রশ্ন আসবে তা কি তার চিন্তাকে বিকশিত করবে? কি শিক্ষা পাবে এর মধ্য দিয়ে শিশুরা? কেন তাদের মধ্যে এই অবাস্তব, মিথ্যা চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোট বেলা থেকেই? শিক্ষার উদ্দেশ্য তো ছোট থেকে শিশুমনে নীতিবোধ, যুক্তিবোধ, মূল্যবোধ বা কল্পনাশক্তির বিকাশ গড়ে তোলা। এই লেখাটির মধ্যে কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ হচ্ছে? বিদ্যাসাগর মশাই এমন বহু আজগুবি গল্প লিখতে পারতেন না তা নয়, কিন্তু তিনি শিশু পাঠ্যসূচিতে এমন ধরনের সব গল্পের অবতারণা করেছেন যেগুলি আজ তাঁর জন্মের প্রায় দু’শো বছরেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আমরা ছোট বেলায় নিজেরা পড়েছি এবং উপভোগ করেছি। আজও বাবা মায়েরা তাঁদের সন্তানদের যত্ন সহকারে সেই গল্পগুলি পাড়িয়ে থাকেন।
পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত এই গল্পটির মধ্যে গাছের চলাফেরার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি একথাও বলা হয়েছে যে, ‘ফুল, ফল মানুষকে উপহার দেয়। মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন যোগান দেয় নিয়মিত। মানুষকে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচায়। নদীর পাড়ে ভাঙ্গন থেকে মানুষকে বাঁচায়। গাছ গাছালি দিয়ে কত ওষুধ তৈরি হয়। কত পাখি গাছে বাসা বাঁধে।’ স্বাভাবিকভাবেই সত্য-মিথ্যা দুটোকেই জড়িয়ে গল্পটিকে উপস্থাপনা করা হয়েছে। ফলে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে শিশুমনে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে নজর দিন। বিভিন্ন শ্রেণিতে সিলেবাসের মধ্যে এমন বহু অসংগতি রয়েছে – যা অনতিবিলম্বে দূর করা দরকার। কিন্তু বছরের পর বছর এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সিলেবাস কেন সংশোধন করা হচ্ছে না? দয়াকরে শিশুমনে এমন আজগুবি ধারণা গেঁথে দেবেন না।