আজ বিকেল: শিক্ষক অপ্রতুলতা রুখতে কলেজ উত্তীর্ণ নব্য স্নাতকদের ‘ইন্টার্ন’ হিসেবে ব্যবহার করার চিন্তাভাবনা করছে রাজ্য সরকার৷ সোমবার নবান্নে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কলেজ অধ্যক্ষদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ খবর জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নব্য স্নাতকরা কলেজজীবন শেষ করার পর চাকরি খোঁজার মাঝে দু’বছরের জন্য ‘ইন্টার্ন’ শিক্ষক হিসেবে পাঠ দিতে পারবেন৷ সাধারণ স্নাতকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে এবং অনার্স সহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তররা মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে ইন্টার্ন হিসেবে সাহায্য করতে পারবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন৷ বিনিময়ে মাসিক সাম্মানিক ভাতা পাবেন তাঁরা। প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে তা দু’হাজার এবং মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আড়াই হাজার টাকা৷
রাজ্য সরকারের নয়া এই পরিকল্পনা কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক৷ একাধিক শিক্ষক সংগঠনের তরফেও রাজ্যের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছে৷ মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি, শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চ ও বিরোধী দলের একাধিক শিক্ষক সংগঠনের তরফে কড়া ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে৷
রাজ্যের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হয়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মিত্র৷ মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ চালু করার সিদ্ধান্ত এককথায় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক৷ আমরা মনে করি যে বিদ্যালয়গুলিতে হাজার হাজার শিক্ষক পদশূন্য থাকায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত, সেখানে সরকার শিক্ষক নিয়োগ না করে শিক্ষিত বেকারদের নামমাত্র অর্থ দিয়ে তাঁদের খাটিয়ে নেওয়ার একটা পরিকল্পনা করছে৷ এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার উন্নতি তো হবেই না, উপরন্তু বাংলায় স্কুলশিক্ষা যেভাবে ধ্বসে গিয়েছে, তা আরও দ্রুত রসাতলের দিকেই যাবে৷ এই ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে৷ অভিভাবকরা দ্রুত সেই সমস্ত বিদ্যালয়গুলি থেকে তাঁদের সন্তানদেরকে নিয়ে যাবেন বেসরকারি স্কুলে৷ আর এভাবেই শিক্ষায় বেসরকারিকরণের পথে প্রশস্ত হবে৷ রাজ্যে বেশ কয়েক হাজার বিএড ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষিত বেকার রয়েছেন, তাঁদের বঞ্চিত করে সকলকে বোকা বানানোর এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার৷’’
স্কুলে ইন্টার্ন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করেছেন শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কিংকর অধিকারী৷ এক বিবৃতিতে তিনি জানান, ‘‘বিদ্যালয়ে হাজার হাজার শূন্যপদে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগ না করে বিদ্যালয়স্তরে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগ করার মাধ্যমে সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে তার আর্থিক দায়ভার ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছে। এর ফলে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার সলিল সমাধি ঘটবে। শিক্ষিত বেকারদের সামনে খুড়োর কল দেখিয়ে যৎসামান্য অর্থ দিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা শুধুমাত্র অমানবিক নয়, অসাংবিধানিকও বটে৷ পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে ছিটেফোঁটা অর্থ দিয়ে পূর্ণ সময়ের মতো করে বেকারদের খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা মধ্যযুগের অমানবিক বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়৷ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যই প্রাধান্য পাবে। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা যতোটুকু তার মর্যাদা নিয়ে টিকে আছে তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে৷ পূর্বতন সরকারের আমলে পার্শ্ব শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে যেভাবে অল্প বেতনের বিনিময়ে খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, একইভাবে আজও শিক্ষিত বেকারদের ছিটেফোঁটা বেতন দিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। এর ফলে শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছবে। পরোক্ষভাবে অভিভাবকদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এতবড় সর্বনাশ আমরা কোনমতেই হতে দিতে পারি না৷ ফলে রাজ্যের সকল শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের কাছে আবেদন আপনারা দল-মত-নির্বিশেষে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলুন৷’’
রাজ্য সরকারের নয়া পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক অনিমেষ হালদার, ‘‘পূর্বতন সরকারের যোগ্য উত্তরসূরি এই সরকার৷ শিক্ষক নিয়োগের মূল সমস্যা সমাধান না করে আগের সরকার পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করেছিল৷ এই সরকারও সেই একই পথে হাঁটতে চলেছে৷ একই ছাতার তলায় দু’ধরনের বেতনক্রম কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ এতে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে৷ আইনি জটিলতা তো আছেই। এছাড়া পূর্ণসময়ের শিক্ষক নিয়োগের দায়ভার ক্রমশ ঝেড়ে ফেলতে চাইছে সরকার৷ মুখ্যমন্ত্রী এর মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধান ও শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের কাজ দু’সেরে ফেলতে চাইছেন৷ অর্থাৎ তিনি ভোটের আগে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে সস্তায় বাজিমাত করতে চাইছেন৷’’