ইন্টার্ন শিক্ষক! বেকারদের নিয়ে পরিহাস, বেগার খাটানোর কৌশল! শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা

কিংকর অধিকারী: তাহলে কি স্কুল সার্ভিস কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হতে চলেছে? কমিশনের চেয়ারম্যানকে দিয়ে যতই বলানো হোক যে, কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চলতেই থাকবে। বাস্তবে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগ হলে এসএসসি তার গুরুত্ব হারাবেই। শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রায় ছয় বছর ধরে যে টালবাহানা চলছে তা থেকে অনেকের আশঙ্কা তো ছিলই। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় সেই ইঙ্গিত

d2d5bd5d836bfc0953a13c0f10bb5338

ইন্টার্ন শিক্ষক! বেকারদের নিয়ে পরিহাস, বেগার খাটানোর কৌশল! শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা

ইন্টার্ন শিক্ষক! বেকারদের নিয়ে পরিহাস, বেগার খাটানোর কৌশল! শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রাকিংকর অধিকারী: তাহলে কি স্কুল সার্ভিস কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হতে চলেছে? কমিশনের চেয়ারম্যানকে দিয়ে যতই বলানো হোক যে, কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চলতেই থাকবে। বাস্তবে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগ হলে এসএসসি তার গুরুত্ব হারাবেই। শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রায় ছয় বছর ধরে যে টালবাহানা চলছে তা থেকে অনেকের আশঙ্কা তো ছিলই। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় সেই ইঙ্গিত বাস্তবায়িত হতে চলেছে। বিদ্যালয়ে যদি শিক্ষকের অভাব থেকে থাকে তাহলে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়? আসলে বিষয়টি সরকারের শিক্ষা নীতির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই ব্রিটিশ সরকারের আমল থেকে আমরা দেখে আসছি যে শিক্ষার দায়ভার সরকার কোনদিনই নিতে চায় না। নবজাগরণের মনীষীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে কথাটি বারবার বলে এসেছিলেন সেটি হলো, শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্ত আর্থিক দায়ভার সরকারকে বা রাষ্ট্রকে নিতে হবে কিন্তু শিক্ষার সিলেবাস, পরিচালনা সহ সমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন শিক্ষাবিদগণ। এখন আমরা দেখছি সরকার শিক্ষার ব্যাপারে তার আর্থিক দায়ভার ক্রমশ চাপিয়ে দিচ্ছে অভিভাবকদের উপর। অথচ সুনিপুণভাবে শিক্ষার উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজটা সরকার করে চলেছে।

রাজ্যের অধিকাংশ সাধারণ বাড়ির সন্তানরা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। হাজার হাজার টাকা দিয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়ার মত অবস্থা তাদের নেই। এমনিতেই বেশ কয়েক বছর ধরে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে রয়েছে। বিদ্যালয়গুলিতে চলছে শিক্ষক সংকট। এসএসসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি সচল করার পরিবর্তে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা প্রচলিত বিদ্যালয় শিক্ষার ভিতকে নড়িয়ে দেবে। পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষিত বেকারদের খাটিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা তা আসলে সস্তায় সস্তা শিক্ষা! বাজারে বেশি দামে ভালো জিনিস আর কম দামে খারাপ জিনিস পাওয়ার মতো। যেমন জিনিসের তেমন দাম। প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় অর্ধেক অংশ এভাবেই চলে গিয়েছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কবলে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে প্রাথমিকের নার্সারি স্কুল। অধিক অর্থ ব্যয় করে মানুষ বাধ্য হয়েছে সেইসব স্কুলে তাদের সন্তানদের ভর্তি করতে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলিত রেখে দেওয়ার পরিণামে এ কাজে সফল হয়েছিল শাসকেরা। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ প্রায় সমসংখ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রাভাবের কারণ দেখিয়ে কলকাতা শহরের বুকেই প্রায় 2000 এর বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারিভাবে এতদিন পর্যন্ত টিকে রয়েছে তাকেও বিভিন্ন কৌশলে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মুনাফা লাভের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই নবজাগরণের প্রভাবে গড়ে ওঠা হাজার হাজার বিদ্যালয় আজ ধ্বংসের পথে। সরকার ক্রমশ তার আর্থিক দায়ভার নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে দিচ্ছে।

সাধারণের কাছে উচ্চশিক্ষা নাগালের বাইরে গেলেও এতদিন পর্যন্ত বিদ্যালয় শিক্ষা সাধারণের কাছে অনেকটা ধরাশায়ী ছিল। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মত বিদ্যালয় শিক্ষাকে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ -এই পর্যায়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থ যার শিক্ষা তার। যতটুকু জানি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাতে কলমে শিক্ষার জন্য ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে কিভাবে সেটি প্রযোজ্য বোধগম্য নয়। তবে এটি পরিষ্কার যে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগ-এর পরিবর্তে ধীরে ধীরে এই ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে অল্প বেতনে নামমাত্র শিক্ষা দেওয়ার যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দু-আড়াই হাজার টাকার বিনিময় যে দায়বদ্ধতার শিক্ষা বিতরিত হবে তার গুণগতমান নিশ্চয়ই উপলব্ধি করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকবৃন্দ তাদের সন্তানদের জন্য অন্য রাস্তা খুঁজতে বাধ্য হবেন। আর্থিক দিক দিয়ে যারা সক্ষম হবেন তারা অধিক অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে ঝা চকচকে বেসরকারি বিদ্যালয় সন্তানকে ভর্তি করবেন শিক্ষা গ্রহণের জন্য। ধীরে ধীরে অন্তঃসারশূন্য- এ পরিণত হবে প্রচলিত সকলের জন্য শিক্ষা পাওয়ার সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলি।

শিক্ষিত বেকারদের সামনে খুড়োর কল দেখিয়ে যৎসামান্য অর্থ দিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা শুধু অন্যায় নয়, অমানবিকও বটে। পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগ-এর পরিবর্তে ছিটেফোঁটা অর্থ দিয়ে পূর্ণ সময়ের মতো করে বেকারদের খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা মধ্যযুগের অমানবিক বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ-এর পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যই প্রাধান্য পাবে। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা যতোটুকু তার মর্যাদা নিয়ে টিকে আছে তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।

গোটা সমাজ যখন আজ বেকারত্বের যন্ত্রণায় ছটফট করছে। একটা যেকোনো কাজের আশায় হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিক্ষিত বেকার সম্প্রদায়। মাত্র দু-তিন হাজার গ্রুপ ডির পোস্টে ২৫/৩০ লক্ষ শিক্ষিত বেকার চাকরির জন্য ফর্ম ফিল আপ করে। তাদের মধ্যে থাকে কেউ পিএইচডি, কেউবা এম এম, এস সি সহ উচ্চ ডিগ্রিধারী! মাত্র দু-আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে নেওয়া হবে তাদের! তাদের কাছে এই ধরনের খুড়োর কল আসলে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার হীন কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতে সুদিনের মরীচিকা আশায় লাইন দেবে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার। তাদের জন্য তৈরি হবে দলীয় এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক। বুকের যন্ত্রণা চেপে রেখে দলের পেছনে হন্য হয়ে ছুটতে থাকবে লক্ষ লক্ষ বেকার। একদিকে যেমন তাদের প্রতিবাদী মনটাকে মেরে দেওয়া যাবে, তেমনি বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে ভিখারীর থেকেও কম রোজগার করা বেতন দিয়ে খাটিয়ে নেওয়া যাবে অনেক।

ভাষাচার্য সুকুমার সেন একটি কথা বলেছিলেন যে, এক সময়ে শিক্ষা মানুষকে বাঁচিয়েছিল কিন্তু এখন শিক্ষাই বিপন্ন, মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য। এ কথা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি আমরা। নবজাগরণের শিক্ষায় আমাদের দেশে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ দেওয়ার যে রীতি তৈরি হয়েছিল তাকে সুকৌশলে তুলে দিয়ে ‘অর্থ যার শিক্ষা তার’ -এই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এভাবেই শিক্ষার দায়ভার আমাদের কর্ণধারেরা ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। বেসরকারি মালিকদের হাতে শিক্ষা আজ মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হচ্ছে। এই আসল সত্যটি যদি না আমরা উপলব্ধি করে সরকারের এই অপচেষ্টা রুখতে পারি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ বাড়ির সন্তানদের জন্য আর কোনো সরকারি বিদ্যালয় অবশিষ্ট থাকবেনা যেখানে ‘সূর্যের কিরণের মতো’ বা ‘বৃষ্টির ধারার মতো’ সমানভাবে সবাই শিক্ষা পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *