শাম্মী হুদা: ঠাকুমা, দিদুন তো গল্প বলে, রান্নাও করে তবে মা কাকিমার মতো প্রতিদিন নয়। কিন্তু রান্নাই যদি করবে তবে যুদ্ধ করবে কখন। অন্য কোনও কাজ ছবি আঁকা, কিম্বা গাড়ি চালানো অথবা লড়াই করা। সেসব কি শুধু ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান মহিলারা করেন, তাঁরাই শুধু একটু হটকে হন? সাত বছরের শিশুকন্যার প্রশ্নে থমকে গিয়েছিলেন কনভেন্টে পড়া আধুনিকা মা।
তাইতো তিনিও দেশের স্বাধীনতা দেখেননি, পরাধীন ভারতের অগ্নিকন্যারা তাঁর বইয়ের পাতাতেই আলো করেছিলেন, তাও সকলে নন। শিশুমনকে যাই বোঝানো হবে সেতো তাই বুঝবে। আগেভাগেই সামাল দিলেন মা, মনের মাঝে ভিড় করে এল একগাদা নাম, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অরুণা আসফ আলি, সরোজিনি নায়ডু, ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ, সুলতানা রিজিয়া, নাহ এসব তো ইতিহাসের পাতা তাঁকে চিনিয়েছে। এঁদের ব্যতিরেকে কোনও মহিয়সী ভারতে জন্মাননি এমন তো নন। এঁদের জয়গাঁথা শোনানোর আগে মেয়েকে নাহয় বাকি মহিয়সীদের কর্মকাণ্ড জানাবেন। ইতিহাস মনে রাখলেও প্রচ্ছন্নেই যাঁদের বসবাস, তাঁরাই নাহয় আগামী প্রজন্মের নারী সত্ত্বার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা নিক।
ছোট্টো মেয়েকে জানাতে হবে ভারতীয় নারী জাতির কৃতিত্বের ইতিহাস, সে তো মোটেই সহজ কথা নয়। মেয়ে যাতে আকৃষ্ট হয় নিজের জীবনের পাথেয় খুঁজে পায় তাই মা নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলেন। একে একে সামনে এল ডক্টর বন্দনা শিবা, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, কেশরবাঈ কেরকার, টেসি থমাস, শকুন্তলা দেবী, ডক্টর মন্দাকিনি আমতে, বেগম হজরত মহল, জানকী আম্মাল, রানি ভেলু নাচিয়ার, ভানু আথাইয়া প্রমুখ। বৈচিত্রময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের এই নারীরা নিজেদের ক্ষেত্র থেকে রীতিমতো লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন,কেউ সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন,কেউ বা সামাজিক ভাবে নারী জাতির উন্নয়নে বড় ভূমিকা নিয়েছেন। এদেশের মেয়েরা চিরদিনই পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে থেকেছেন, সৌজন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যার মূলে কুঠারাঘাত করে নবজাগরণের ফল্গুধারা নারীরাই এনেছিলেন তাঁদের উত্তরসূরিদের জন্য।
এঁদের হাতধরেই একটু একটুকরে সুগঠিত হয়েছে ভারতবর্ষ, যা আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রের তকমা পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনত্তোর ভারতের ইতিহাস বইতে এই সব মহিয়সীদের গৌরব গাঁথা কোনও জায়গা পায়নি। তাই নবজাগরণের পথিকৃৎ হয়েও এঁরা অন্তরালে থেকে গিয়েছেন। কিন্তু একজন আত্মনির্ভরশীল নারী ও মা হিসেবে তাঁদের কৃতিত্বকে অস্বীকার করি কীভাবে। তাই দুই মেয়ের জন্যই শুরু হল বই লেখার কাজ। ওই মহিলা ১০ মহিয়সী নারীর কৃতিত্বের আখ্যান সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, না বই ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করে ক্ষান্ত হননি তিনি। বইতে লেখক পক্ষপাত দুষ্ট হতে পারেন, ছাপার ভুলও থাকতে পারে।তাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে দশ নারীর গৌরব গাঁথার বিবরণী লিখে ফেললেন শিশুকন্যার মা।
বইগুলিকে তথ্যবহুল করতে এই সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার পড়লেন, তথ্যচিত্র দেখলেন বই তৈরি হল, তারপর নিজের হাতে একে একে শকুন্তলা দেবী –সহ ১০ জনের ছবিও আঁকলেন। সেসব ছবিই হল বইয়ের প্রচ্ছদ। গরমের ছুটিতে সেই বইই মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হল।প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন বইয়ের পাতা উল্টে এই সব প্রেরণাদাত্রীদের গল্প পড়তেন মা, হাঁ করে সেসব শুনতো দুই শিশুকন্যা।হ্যাঁ এইভাবেই মেয়েদের আগামীর পথকে চিনতে শিখিয়েছেন এই নারী। অতীতের নারী আন্দোলনকে চারিয়ে দিয়ে তাঁর মেয়েরা আগামীর গর্ব ভারতের পরিচয় হয়ে উঠুক, এটাই কাম্য।