তিয়াষা গুপ্ত: রাজনীতিতে কোনো আইকনের মত্যুর পর সেই আবেগ ভোটবাক্সে কাজে লাগানোর রেওয়াজ আছে। পূর্বে এমনটা অনেক হয়েছে। সম্প্রতি করুণানিধি থেকে অটল বিহারী বাজপেয়ীর মৃত্যুর পর সেই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেই আবেগ অন্যভাবে প্রবাহিত। এই রাজ্যে রাজনীতির সীমানা পেরিয়ে শিল্প-সাহিত্যের জগতের নক্ষত্রদের মৃত্যুর পরেও সরকারি স্তরে শ্রদ্ধা জানানোর রেওয়াজ আছে। (বরং এখানে একটু বেশিই) কিন্তু এই প্রয়াস ছুঁতে পারল না পরিচালক মৃণাল সেনকে। তিনি এসবের থেকে অনেক দূরেই রয়ে গেলেন। মরদেহ নিয়ে রাজনীতির হালফিল ট্রেন্ড আগেই `খারিজ’ করে দিয়েছিলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেস শেষযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তানিয়ে শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয় সেসময়। পুরো একটা দল নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। এসব দেখে শুনেই কি মৃণাল সেন চেয়েছিলেন, তাঁর অন্তিম যাত্রা সরকারি প্রভাবমুক্ত হোক?
তিনি চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তিম শ্রদ্ধা হবে না। এই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে তৈরি রাজ্য সরকারও। (উপায় কী?)মৃণাল সেনের মরদেহ রাখা আছে তপসিয়ায় কলকাতা পুরসভার পরিচালনাধীন পিস ওয়ার্ল্ডে। শেষ কৃত্য হবে তাঁর ছেলে শিকাগো থেকে শহরে ফিরলে।
কিন্তু তিনি নিজে ও তাঁর ছবি তো রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল না। মার্কসবাদ তাঁকে ছাত্রাবস্থা থেকে আকর্ষণ করেছে। সিপিএমের সদস্য না হয়েও বামপন্থী ভাবনা যা তাঁর মননে ছিল, তাই চিত্রিত হয়েছে তাঁর ছবিতে। নিয়ম ভাঙাই ছিল তাঁর নিয়ম। বারবারই তিনি নিজেকে `পার্সোনাল কমিউনিস্ট‘ হিসেবে দাবি করে এসেছেন। ফরাসি নিউ ওয়েভের আশ্চর্য প্রভাব পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে। শিল্পের গতানুগতিক নিয়ম কানুনকে কোনো কেয়ার করেননি তিনি। স্বতন্ত্র এক চলচ্চিত্র ভাষা তৈরি করেছেন তিনি।
খাদ্য আন্দোলন থেকে নকশাল আন্দোলন, মানুষের অসহায়তা, অন্যদিকে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা মৃণাল সেনকে প্রতিবাদী করে তোলে। সত্তরের পরিচালকের ৩ টি ছবি ইন্টারভিউ, ক্যালকাটা ৭১, পদাতিক-এ সম্পূর্ণ অন্য ভাষার সন্ধান করেছেন তিনি। সিনেমা নয়, তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে ম্যানিফেস্টো। ফরাসি নিউ ওয়েভের ছায়া ভিড় করেছিল তাঁর পরের পর ছবিতে।
নন্দীগ্রামে গণহত্যার ছায়া কলকাতার বুকে এসে পড়েছিল। সেসময় পথে নেমেছিলেন তিনি। সেই নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। এরপরে পরেই তিনি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মিছিলেও পা মেলান। প্রশ্ন ওঠে তিনি ঠিক কোন দিকে। ডানে না বামে? মৃত্যুর পর রাজনীতির ছায়া থেকে দূরে থেকে প্রমাণ করে দিলেন, তিনি কোনো দলের নন, রাজনৈতিক আদর্শ অন্য জিনিস। তিনি শিল্পের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন চিরকাল।