কলকাতা: বাংলা ছাড়া আর কোনও বিষয়ে বানান ভুল হলে নম্বর কাটা যাবে না সম্প্রতি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এই নির্দেশিকা ঘিরে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে রাজ্য জুড়ে। শিক্ষকমহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে এর ফলে শিক্ষার মান কোথায় নেমে যাবে তাই নিয়ে?
নির্দেশিকা অনুসারে- পর্ষদের যুক্তি, মূলত ভাষা বিষয়ে অর্থাৎ বাংলা পরীক্ষার ক্ষেত্রে বানান ভুলের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়াটাই একমাত্র যুক্তিসম্মত। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস,ভূগোলের মতো বিষয়গুলিতে উত্তর যথাযথ কিনা, সেটাই আসল বিচার্য বিষয়। সেখানে বানান ভুলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এতদিন ধরে এই বিষয়গুলিতেও বানান ভুলের জন্য অনেক সময় শিক্ষকরা নম্বর কেটে নিতেন। এবার থেকে তা করা যাবে না বলেই পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছে।
তবে অনেকেই হয়তো জানেননা বা জানলেও তার এড়িয়ে যেতে চাইছেন যে এবিষয়ে বহুদিন আগে থেকেই কেন্দ্র সরকারি স্কুলগুলিতে নির্দেশিকা জারি আছে। এক্ষেত্রে ২০০৮-এর 'টাইমস অফ ইন্ডিয়ার' একটি প্রতিবেদন পুরোনো হলেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে,তাদের কাছে এমনই খবর আছে যে, আন্তর্জাতিক বোর্ড থেকে শুরু করে এদেশের সিবিএসই, আইসিএসই, আইজিসিএসই (ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন)-র বোর্ডের পরীক্ষায় এমন নিয়ম আছে যেখানে বানান ভুলের জন্য নম্বর কাটা যাবেনা।
শুধুমাত্র যদিনা সেই ভুল বানানের জন্য শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়। এমনকি বানান ভুল হলেও উত্তর যদি সঠিক হয় সেখানে বানান ভুলের জন্য নম্বর কাটা যাবে না। এপ্রসঙ্গে তৎকালীন আইসিএসই বোর্ডের চেয়ারম্যান নেইল ও'ব্রায়ন নিজের স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে বলেছিলেন যে ” বানান ভুল নম্বর কাটার পর্যাপ্ত কারণ নয়। ভাষা বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে কোনো পরীক্ষার্থী একটি বানান ভুল করলে তার মূল্যায়ণ এভাবেই হওয়া উচিত যে সেই পরীক্ষার্থী অন্যান্য উত্তরগুলি কতটা ভালো লিখেছে।” এই বানানের ঠিক-ভুলের বিষয়টিকে একটি 'মৃত শিল্প' বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এগজামিনেশনের জেনারেল ম্যানেজার ইয়ান চেম্বার তো আরও একধাপ এগিয়ে ভাষা শিক্ষাকে একধরনের শিল্প বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ভাষা শিক্ষার অর্থ সাক্ষরতা, সাবলীলতা এবং অর্থ বোঝানোর ক্ষমতা আর বানান এবং ব্যাকরণ শেখানোর ক্ষমতা এই শিল্পের সর্বোচ্চ আকার। অর্থাৎ নির্ভুল ভাষা শিক্ষার ওপর তখনই জোর দেওয়া হবে যখন শুধুমাত্র ভাষাকে বিশেষ এবং পৃথক বিষয় হিসেবে পড়ানো হবে। চমৎকার বলেন “আমরা কোনও শিক্ষার্থীকে খারাপ বানানের জন্য সক্রিয়ভাবে শাস্তি দিই না যদি না এটি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” তিনি আরো বলেন ” নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নে পরিপাটি লেখা বা নির্ভুললেখার জন্য যদি আলাদা করে নম্বর দেওয়ার কথা উল্লেখ করা থাকে সেখানে নির্ভুল বানানের বিষয়টি নিশ্চই কাজে আসবে।”
সিবিএসইর আঞ্চলিক কর্মকর্তা এন নাগরাজু ও এসএসসি চেয়ারপারসন বিজয়শিলা সারদেসাইয় জানিয়েছিলেন যে বানান ভুলের জন্য নম্বর কাটা হয় না। যদিও একটু পুরোনো চিন্তাধারা রাখেন যে শিক্ষকরা যেমন তেজগাঁওয়ের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের তৎকালীন প্রিন্সিপল কার্ল লঁরি বানান ভুল মানে 'ভাষার মৃত্যু' বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও এক্ষেত্রে তিনি ভাষা নিয়ে উচ্চশিক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন যার জন্য বানান শুদ্ধ হওয়াটাও খুব জরুরি বলেই উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
তবে বানান ভুলের বিষয়টি শুধুমাত্র ভারতীয় বিষয় নয়। এটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষাবিদরা এনিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এদের সবাই কিন্তু শিক্ষার্থীদের বানানে দুর্বলতা নিয়ে ততটাও দুঃখিত নন। এনিয়ে যুক্তরাজ্যের বকস নিউ ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি লেকচারার স্মিথ সম্প্রতি তাঁর টাইমস হায়ার এডুকেশন সাপ্লিমেন্ট (উচ্চতর শিক্ষার পরিপূরক)-এ লিখেছিলেন যে, “আমাদের শিক্ষার্থীরা সাধারণত যে শব্দগুলি ভুলভাবে উচ্চারণ করে থাকে, সেই শব্দগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবশ্যই বিকল্প হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।” 'এমনকি তিনি এই ধরনের শব্দ গুলির একটি তালিকাও তৈরি করেছিলেন। (টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ২০০৮-সালের একটি প্রতিবেদন)