জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে না জানে বাচাবে? ৩য় পর্ব

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে না জানে বাচাবে? ৩য় পর্ব

তপন মল্লিক চৌধুরী:  জাতীয় শিক্ষানীতি অনলাইন শিক্ষার অপর যথেষ্ট জোর দিয়েছে। এতকাল ধরে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে এসেছে সেই ধারা থেকে সরে আসতে চায় নতুন শিক্ষানীতি। কিন্তু  প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা কি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সহায়ক, অথবা তার বিকল্প হতে পারবে? ‘‘মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে  … প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে, … গুরু–শিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষা কার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মত চলিতে পারে’’৷ ( ‘শিক্ষাবিধি’; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

আরও পড়ুন- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে, না জানে বাঁচাবে? প্রথম পর্ব

সরকার যে অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন তা শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর এবং যন্ত্রনির্ভর। শিক্ষা প্রযুক্তিনির্ভর হলেওতা শিক্ষক ও ছাত্রের বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলে৷ কিন্তু নতুন শিক্ষানীতি যে প্রযুক্তির কথা  বলছে তা শুধুমাত্র যন্ত্রনির্ভর। সেখানে প্রাণের কোনও স্পন্দন নেই। প্রশ্ন হল যন্ত্র কি কিশোর বা যুবমানসে কোনও প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে? বিষয়ের সঙ্গে ছাত্রের কোনও আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারবে?

যন্ত্র ছাত্রদের শুধুমাত্র লেকচার দেবে একটি বিষয় নিয়ে। পারবে না ছাত্রের মনে কোনও আগ্রহ তোইরই করতে। পারবে না ছাত্রকে স্বপ্ন দেখাতে। পারবে না ছাত্রের মননশীলতা সৃষ্টি করতে। যন্ত্র কেবলমাত্র ‘রোবোটিক’ কিছু মানুষের জন্ম দেবে। অন্যদিকে কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার আর্থিক সামর্থকে ভিত্তি করে যে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ তাতে সমাজে দু’ধরনের ছাত্র সৃষ্টি হবে৷ একদল বড় বেশী ডিজিটালাইজ হয়ে উঠবে আরেক দল ক্রমশ যন্ত্রের চাপে হতাশায় তলিয়ে যাবে। অন্যদিকে ১৩৭ কোটি দেশের ছাত্র সমাজকে যদি ল্যাপটপ–স্মার্টফোন কিনতে বা আম্বানিদের মতো ব্যবসায়ীদের ‘ডেটা’ সিম ব্যবহার করতে বাধ্য করা যায় তাতে কর্পোরেট হাউসগুলির রমরমায় আশীর্বাদ জুটবে শাসক গোষ্ঠীর কপালে৷

আরও পড়ুন- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে না জানে বাচাবে? ২য় পর্ব

জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘ন্যায়ের ভিত্তিতে সকলের জন্য সমমানের শিক্ষা প্রদান’ জাতীয় শব্দগুলির উল্লেখ আছে ছত্রে ছত্রে, শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসাবে। কিন্তু তা যে অসাড় তা বোঝা যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। যেমন; গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি অন্তর্ভুক্তির ফলে সরকারের বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হতে বাধ্য। আর সেই আশঙ্কায় বড়লোক অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেসরকারি স্কুল বেছে নাবে আজকের থেকেও অনেক বেশী করে৷ ফলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা আরও বাড়বে। দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুলবে৷ কিন্তু সেখানে কোন পড়ুয়ারা জায়গা পাবে? সরকার নিজেই নাকি তিনটি অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়বেন– গবেষণা কেন্দ্রিক, শুধুমাত্র শিক্ষণের জন্য এবং ডিগ্রি দেওয়ার অটোনমাস কলেজ। এতে একটাই কাজের কাজ হবে এখনকার থেকে আরও বেশী বৈষম্যের শিকার হবে পড়ুয়ারা।   

সরকার নতুন শিক্ষানীতিতে বহুত্ববাদিতা, বৈচিত্র্য এই সব বিশেষণ আওড়েছেন। তাঁরা বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী, বহু সংস্কৃতির দেশে এক পাঠ্য–বিষয়, এক পরীক্ষা, এক প্রবেশিকা পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করবেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শিক্ষা যে যুগ্ম তালিকায় আছে তা কি তাঁরা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চাইছেন?  সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেবেন বলছেন এদিকে সংসদ এড়িয়েই জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে ফেললেন৷ সংসদ চলছে না, সংসদের কোনও কক্ষে আলোচনার সুযোগ নেই, বিরোধীদের মতামত দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। তবু তাড়াহুড়ো করে জাতীয় শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্যাবিনেটে পাশ করিয়ে তাকে চালু করার উদ্দেশ্যটা কি? মহৎ উদ্দেশ্য যে নেই তা তো প্রক্রিয়াই বলে দিচ্ছে এ ছাড়া আর কী থাকতে পারে?  লকডাউন পরিস্থিতিতে রাস্তায় তুমুল প্রতিবাদ নেমে আসবে না। সেই সুযোগটাই সরকার নিলেন। কিভাবে আগে থেকেই সেটা আন্দাজ করলেন, আর কেন এই চিন্তা সরকারের মাথায় এল? তারমানে সরকার নিজেও জানেন যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ নামে একটি অশ্বডিম্ব তারা প্রসব করেছেন যা দিয়ে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে খুব দ্রুত ধ্বংস করে ফেলা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + six =