মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান কোন পথে?

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান কোন পথে?

fc21789b963238f35d78823f1ccede60

 

b0276218ac641a407afed15572e23b5b
কিংকর অধিকারী

কিংকর অধিকারী:  মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। একপক্ষ বলছেন, পরীক্ষা বাতিল করে দিয়ে ফলাফল ঘোষণা করা হোক। আর এক পক্ষ বলছেন, পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যথাযথ মূল্যায়ন হোক। কেউ বলছেন, কঠোরভাবে কভিড বিধি মেনে অফলাইনে পরীক্ষা হোক। আবার কেউ বলছেন, পরীক্ষা হোক অনলাইনে।

এই বিতর্কের মাঝেই সিবিএসই আইসিএসই বোর্ড তাদের পরীক্ষা বাতিল করে দিয়েছে। রাজ্যের সিদ্ধান্ত ছিল পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে জুলাই এবং আগস্ট মাসে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও পরীক্ষা বাতিল করে দিয়ে ফল ঘোষণার দিকে এগোচ্ছে।     পরীক্ষা বাতিল করে ফল ঘোষণার পক্ষে যাঁরা, তাঁরা যুক্তি দিয়ে বলছেন যে, সারাবছর বিদ্যালয়ে ক্লাসই হলো না, তাহলে পরীক্ষা হবে কীসের ভিত্তিতে? ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা করলে তো তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে? তাই তাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক চাপ না দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী।

অপরপক্ষ বলতে চাইছেন, পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন কিভাবে সম্ভব? দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে কোনো পরীক্ষাই তাদের হয়নি, তাহলে কীসের ভিত্তিতে হবে মূল্যায়ন? এ কথা ঠিক শিক্ষক, অভিভাবক এবং আমজনতার মধ্য থেকে এ বিষয়ে যে ভিন্ন দুটি মত উঠে আসছে তাঁরা কেউই ছাত্র-ছাত্রীদের শত্রু নয়, তাঁরা প্রত্যেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গল চান। এই মন নিয়েই তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন যুক্তির অবতারণা। এখানে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যাঁরা আমরা বলছি, পরীক্ষা না নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেওয়া হোক তাঁরা কি প্রকৃতই ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গলের জন্য বলছি? যদি এ প্রশ্ন উঠে যে, বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন হলো না, শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখলো না তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কীভাবে? এর উত্তরে বলি, যদি সত্যিই ছাত্রছাত্রীরা কিছুই না শিখে থাকে তাহলে তাদের ঢালাও নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে বা উচ্চশিক্ষায় গিয়ে তারা কি কিছু করতে পারবে? মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরীক্ষায় তারা যদি কোনভাবেই কাঙ্খিত মান অর্জন না করে পরবর্তী পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায় তাহলে সেইসব ছাত্র-ছাত্রী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে তো? বরং পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে যারা কাঙ্খিত মান অর্জন করতে পেরেছে তাদের উত্তীর্ণ করার মধ্য দিয়ে পরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। আর যাঁরা অনলাইন পরীক্ষার কথা বলছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করার মতো অনলাইন ব্যবস্থা কোনভাবেই বাস্তবসম্মতভাবে কার্যকরী হতে পারে না। অনলাইন পরীক্ষা আসলে এক ধরনের ‘ওপেন বুক এক্সাম’ অর্থাৎ বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। একেবারে নিচু স্তরে এই প্রক্রিয়া চালু, আর পরীক্ষা না নিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এর ফলে ভবিষ্যতে এই বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের গুণগত মান নিয়ে সর্বত্র একটা উপহাস্যের যায়গা তৈরী হবে যা তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে অত্যন্ত অসম্মানের।

কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির নীতিতেই রয়েছে ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অনলাইন এবং ওপেন বুক এক্সাম পদ্ধতি, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ধাপে ধাপে পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলিকে নিয়ে আসা। করোনার প্রকোপ তাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এই নীতি গুলিকে কার্যকর করে নেওয়ার জন্য। সরকার বরাবর চায় মানুষ প্রকৃত শিক্ষা না পাক। যুক্তি, বিজ্ঞান, বিবেক, মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষা তাদের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে আশীর্বাদ। সেই সরকারি নীতি গুলিকে এই সুযোগে তারা কার্যকরী করে নিতে চাইছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ বিদ্যালয় গুলির মধ্য দিয়েই হয়ে থাকে। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, সামাজিক বোধ, বন্ধু প্রীতি, উন্নত রুচি, সংস্কৃতি ইত্যাদির শিক্ষা বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই হয় – যা কোনভাবেই আত্মকেন্দ্রিক, চার দেওয়ালের মধ্যে অনলাইন শিক্ষায় সম্ভব হতে পারে না। সরকারের এই সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য গুলিকে আমরা নিজেদের অজান্তেই স্বীকার করে নিচ্ছি না তো? সরকার যদি সত্যিই ছাত্র-ছাত্রীদের গুণগত শিক্ষা উপর জোর দিত তাহলে বিশ্বব্যাপী এইরকম একটা সংকটের সময় এবং জাতীয় সংকটের দিনে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের পরীক্ষা(ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষাসহ) এক বছরের জন্য পিছিয়ে দিলে বিরাট কি ক্ষতি হয়ে যেত? এইরকম একটা সংকটের সময় এক বছর প্রত্যেকে তার তার শ্রেণীতে থেকে পরের বছর সামগ্রিক প্রস্তুতির ভিত্তিতে যদি তারা উত্তীর্ণ হতো তাহলে গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা থাকত না। আর এই এক বছরের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের প্রত্যেককে ভ্যাকসিন প্রদানসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি সম্পন্ন করে ফেলতে হতো। এ সিদ্ধান্ত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেই নিতে হতো। রাজ্য সরকারগুলোকে কিন্তু এই দাবি কখনো তুলে ধরতে দেখা যায়নি। শিক্ষার বিষয়টিকে কোনো সরকার যে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি তার নজির আমরা দেখেই চলেছি।

আর পরীক্ষা নিতে গেলে সরকারকে অবশ্যই কঠিন দায়িত্ব নিতে হবে। আর অন্যান্যদের আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে করোনার প্রকোপ যখন নিম্নমুখী হচ্ছে তখন সারা রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয় গুলিকে যথাযথ স্যানিটাইজ, দূরত্ব বিধি মেনে, মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হোম সেন্টারে পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে এবং ওই পরীক্ষার দিনগুলিতে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতি না রেখে কেবলমাত্র পরীক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয়গুলিকে চালু রেখে অন্যান্য বিষয়গুলিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিদিন বিদ্যালয় গুলিকে পরীক্ষার পর স্যানিটাইজ করতে হবে। এককথায় কঠোরভাবে কভিড বিধি অনুসরণ করে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে নীতিগতভাবে ঘোষণা করতে হবে। তাতে সারা রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই কাজটি করা যেতে পারে। কঠিন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনা বরং কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এটাই মানব জীবনের ইতিহাস। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা কি দেখেছি? সর্বত্র জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক রেখে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চালু রেখে কেবলমাত্র শিক্ষা কেন্দ্র গুলিতে পঠন পাঠন বন্ধ করে রাখা হল অথচ গ্রামগঞ্জে ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে টিউশন পড়তে গেলো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিল, খেলাধুলা, সামাজিক অনুষ্ঠানে মেলামেশা করল। কেবল বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন বন্ধ থাকল! আগামী দিনেও এই একই চিত্র আমরা দেখতে পাবো। ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক চাপ তো কেবল পরীক্ষাকে কেন্দ্র নয়, তাদের নিজেদের প্রাণকেন্দ্র বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে রেখেই তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় রাখা হয়েছে। মাঝে কিছুদিনের জন্য নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পঠন-পাঠন শুরু হয়েছিল। তাতে কি বিরাট কোন অশণি সঙ্কেত আমরা দেখতে পেয়েছিলাম? নির্বাচন আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ভাবিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাঁচবে এবং রক্ষা পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *