কিংকর অধিকারী: প্রায় দেড় বছর হতে চললো বিদ্যালয়গুলিতে পঠন পাঠন বন্ধ। কয়েকদিনের জন্য নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পঠন-পাঠন চালু করা হয়েছিল। তারপর আবার শিক্ষার্থীগণ গৃহবন্দী। শুধু বিদ্যালয় নয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় একইভাবে শিক্ষার অন্ধকারে।
এই সময়কালটিতে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীগণ কিভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছে? অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা, কিছু কিছু শহুরে এলাকার বিদ্যালয়, প্রাইভেট টিউটর, সচেতন এবং শিক্ষিত বাবা-মায়েরা উদ্যোগী হয়ে এই সীমাবদ্ধ অবস্থার মধ্যেও কীভাবে পঠন-পাঠন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার একটা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে প্রথম ঢেউ যখন শিক্ষাব্যবস্থাকে অচল করে দিয়েছিল তখন সেই প্রথম অবস্থায় সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত প্রচেষ্টা কতখানি সমগ্র শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে তা দেখা যাক।
দেখা গেছে ২০-৩০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী এই অনলাইন বা দূর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার এই মাধ্যম গুলিকে মোটামুটি ব্যবহার করেছে এবং নিজেদের পরবর্তী শ্রেণির উপযোগী করে গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে। বাকি ৭০- ৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীগণ বিদ্যালয়হীন শিক্ষা গ্রহণের এই মাধ্যম গুলিকে প্রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে অভিভাবকদের অসচেতনতা, দৈনন্দিন কোনো টাস্ক না থাকা, শিক্ষা বর্ষের শুরুতেই করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর সরকারি ঘোষণা- পরীক্ষা হবে না, সবাই পাশ। আর এ বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা তো বাতিল করে দিয়েছে সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য নীচু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ধারণাই তৈরি হয়ে গিয়েছে তাদের প্রতিও সরকার নিশ্চয়ই সদয় হবে। ফলে না পড়ে, না জেনে অষ্টম মান পর্যন্ত পাশ করার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের বিরাট অংশের মধ্যেও বেশ জাঁকিয়ে বসেছে।
রাজ্যের অনেক শিক্ষক শিক্ষিকার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা গিয়েছে করোনা কালীন অচল শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম যখন দূর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, ফোন, বা বিভিন্ন অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল তখন দেখা গিয়েছে প্রথম কিছু দিন এই প্রক্রিয়া গুলি চললেও তারপর সেই প্রক্রিয়াতে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ প্রবল ভাবে কমতে থাকে।
বর্তমানে বহু শিক্ষক শিক্ষিকা বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন চ্যাপ্টা অনলাইনে, ইউটিউবে ছাত্র ছাত্রীদের পাঠদানের জন্য লোড করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনলাইনে সার্চ করলেই ফ্রিতে প্রতিটি ক্লাসের বিভিন্ন পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যাবে। কিন্তু বিদ্যালয় শিক্ষার বিকল্প হিসেবে এই শিক্ষা যে কোনো ভাবেই কার্যকরী নয় তার প্রমাণ আজ ছত্রে ছত্রে। যাদের সুযোগ নেই আলাদা কথা, কিন্তু যাদের সুযোগ রয়েছে তাদের বিরাট অংশের মধ্যে এই শিক্ষা গ্রহণের কোনো আগ্রহ নেই।
অনেকে বলছেন, যতদিন না ভাইরাস নির্মূল হয় ততদিন ছাত্র-ছাত্রীরা ঘরে বসে অনলাইনে পড়াশোনা করে নিক। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, কিছু সচেতন পরিবারের ছাত্র ছাত্রী ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউই এই পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণের ধারে কাছে নেই। যারা রয়েছে তারা অস্থির হয়ে উঠছে। চার দেওয়ালের গন্ডির মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাধকতার পরিবেশ তাদের মানসিক জগতকে নষ্ট করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। সামাজিক আচার-আচরণ, বন্ধু প্রীতি, সমাজবোধ, অন্যের প্রতি মমত্ববোধ, সমস্ত গুণগুলো আজ সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের মধ্য থেকে। সারাক্ষণ মৃত্যু সংবাদ, মোবাইল আসক্তি, কিংবা সংসারের বিভিন্ন ধরনের একঘেয়েমি আলোচনা ইত্যাদির মধ্যে থেকে আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে ছোটরা।
হয়তো একটা অংশের ছাত্র-ছাত্রী অনলাইন শিক্ষার ধারে-কাছে যেতে পারেনি কিন্তু যাদের পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব, বাড়িতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন রয়েছে তারা কতটুকু সেই শিক্ষা গ্রহণ করছে তার পরিসংখ্যান যদি নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে তার অত্যন্ত সামান্য অংশ এই শিক্ষায় আগ্রহী। তাই যাঁরা ভাবছেন দূর থেকে কোন পদ্ধতির মাধ্যমে অথবা অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ধারাটিকে বজায় রাখবেন তারা আসলে ৭০-৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাটাকে সম্পূর্ণরূপে আটকে দেওয়ার চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলেন। আর সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক বিকাশটাকেও আটকে দিলেন।
বড় বড় বই দোকানগুলিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা কালিন সময়ে পাঠ্য বই বিক্রি একেবারে তলানিতে। বড় বড় পাবলিশার্সদের কাছেও একই খবর। ২০২১ সালে নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে পড়ার জন্য বইপত্র কেনেনি বললেই চলে। একেবারে সামান্য কিছু জন অল্প কিছু বইপত্র কিনেছে বাড়িতে পড়াশোনার জন্য। একে কেন্দ্র করে বই বাজারও বিরাট সঙ্কটে। ২০২০ সালে মার্চ মাস থেকে বিদ্যালয়গুলিতে পঠন পাঠন বন্ধ। তার কিছুদিন পরেই সরকার ঘোষণা করে জানিয়ে দেয় সবাই পাশ অর্থাৎ পরবর্তী শ্রেণিতে তারা উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। ফলে শিক্ষাবর্ষের প্রায় শুরু থেকেই না পড়ার অভ্যেস শুরু হয়ে গেল। তারপর থেকে তাদের মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছে না পড়েই পাশ করানোটা সরকারের দায়। সামান্যতম উদ্যোগে পড়াশোনার তাগিদটা বাতিল হয়ে গেল সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে।
যে ছাত্র বা ছাত্রীটি ২০২০ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো সে এখন বিনা পরীক্ষায় নবম শ্রেণীতে। এই শিক্ষাবর্ষের ছটা মাস অতিক্রান্ত। আগামী দিনে কবে বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন চালু হবে সে ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। যদি দু এক মাস ক্লাস হয় বা না হয় আগামী দিনে ওই ছাত্র-ছাত্রীগণ যে বিনা বাধায় দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে সে কথা সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা জেনেই গিয়েছে। একই অবস্থা অন্যান্য শ্রেণির ক্ষেত্রেও। এর ফলে ৭০-৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী শ্রেণি শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন না করেই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। এবছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও পরীক্ষা না দিয়ে তারা পরবর্তী শিক্ষায় প্রবেশ করবে। ফলে প্রায় দু’বছর ধরে না পড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত কোথায় দাঁড়িয়ে? শিক্ষার গুণগত মান কোথায় চলে যাচ্ছে?
অনেকে বলছেন ‘আগে জীবন, পরে শিক্ষা’। আর কতদিন এভাবে আমরা জীবনের দোহাই দিয়ে শিক্ষাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাব? আগামী কয়েক বছর ধরে যদি এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলতেই থাকে তাহলে কোথায় যাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রকোপ একটু কমলেই সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। বাজার-হাট, মিটিং-মিছিল-সমাবেশ, শপিংমল, সামাজিক অনুষ্ঠান সমস্ত ক্ষেত্র প্রায় স্বাভাবিক হবে কিন্তু বিদ্যালয় পঠন-পাঠন শুরু করার প্রশ্ন এলেই যত আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। কঠিন পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার নামই জীবন। এতদিন পরেও শিক্ষাব্যবস্থা সচল করার জন্য কেন সদর্থক চিন্তাভাবনা করা গেল না? কেন ছোটদের জন্য ভ্যাকসিন দিয়ে সমস্ত ধরনের সুরক্ষা আয়োজন করে তাদের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা গেল না? পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই বিদ্যালয় গুলিকে সচল করতেই হবে। প্রয়োজনে অল্টারনেটিভ করে, দূরত্ব বিধি, স্যানিটাইজার, মাস্ক সহ সমস্ত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদ্যালয় শিক্ষা চালু করতেই হবে এবং সাথে সাথে বিদ্যালয়গুলিতে যাতে কাছাকাছি এলাকার শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীগণ থাকতে পারেন তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অনলাইন আবেদনের ভিত্তিতে ট্রানস্ফার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এর ফলে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যাতায়াত করতে হবে না। সহজেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুল এলাকার কাছাকাছি জায়গা থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বিদ্যালয়ে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সহজে পাঠদানে নিয়োজিত হতে পারবেন।
এই কভিড পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় গুলিতে যদি এই নিয়মগুলি মেনে ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠনের প্রক্রিয়ায় না আনা যায় তাহলে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। বছরের পর বছর উপযুক্ত বা কাঙ্খিত মান অর্জন না করে শুধু পাশ করিয়ে দেওয়ার সস্তা নীতি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎটাকে গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। আর কয়েকটা বর্ষ এইভাবে না জানে, না পড়ে শিক্ষার্থীরা উঁচু ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে থাকলে শিক্ষা এবং অশিক্ষা দুটি সমার্থক বস্তুতে পরিণত হবে। সরকারগুলো তাদের ঘোষিত এবং অঘোষিত শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষার দায়দায়িত্ব যে ক্রমশ ছেঁটে ফেলে ফেলতে চাইছে এ উদাহরণ আমরা বহু ক্ষেত্রেই পেয়েছি। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি তাদের এই নীতি গুলিকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে পেয়ে গেল। তাই তারা ‘নো ডিটেনশন পলিসি’, ‘অনলাইন শিক্ষা’ কিংবা বাড়িতে বসে ‘অনলাইন ওপেন বুক এক্সাম’ ইত্যাদি প্রথাগুলি চালুর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটু একটু করে পঙ্গু করে দিতে চাইছে। সেই সুকৌশলী পদক্ষেপকে আমরা সচেতন নাগরিকবৃন্দ যদি না ধরতে পারি তাহলে আগামী দিনে শিক্ষা আরো বেশি করে অর্থবানদের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। সাধারণ বাড়ির ছেলে মেয়েদের থেকে শিক্ষা চলে যাবে নাগালের বাইরে, শত যোজন দূরে!
আসুন, সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন শুরুর জন্য সরকারের কাছে আমরা জোরালোভাবে দাবি জানাই–
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই অতি দ্রুত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষার দিকটি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ব বিধি ইত্যাদি মেনে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত স্যানিটাইজ করে পঠন পাঠন শুরু করতে হবে।
অনলাইন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদের যতটা সম্ভব নিজের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি এলাকায় ট্রান্সফারের জন্য অতি দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সকল শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ আসুন, সরকারকে আমরা এই দাবি মানতে বাধ্য করি। শিক্ষাব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখে! আমাদের সচেতন ভূমিকার মধ্য দিয়ে যেমনভাবে মারণ ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থাকেও আমাদের রক্ষা করতেই হবে।